আজ পহেলা বৈশাখ বাংলা ১৪২৭- পহেলা বৈশাখের ইতিহাস ও কিছু কথা।

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ পীর আবদুল মান্নান: কি ভাবছেন ? পহেলা বৈশাখ ইতিহাস তুলে ধরব এখানে? না ভুল ভাবছেন ।ইতিহাস ভিতরের ইতিহাস নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা যাক । তার আগে বলি ,ছোটবেলায় আমার পহেলা বৈশাখ কিভাবে কেটেছে । আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে ।পহেলা বৈশাখার আগের দিনকে বলা হত হারইনের দিন (যদি বাংলা ব্যাকরনে এইরকম দিনের নাম নেই ,যেটা আছে সেটা হল চৈত্রসংক্রান্তি ) ।হারইনের দিনে আমদের বড় বোনদের সাথে মিলে ছোট ছেলেমেয়েরা নানারকম শাক-সবজি খুঁজতাম ।

বিশেষ করে বহই ফল(যেটাকে সবাই ডুমুর নামে চিনে ) লাগতই । জীবনে কখনও কোনদিন গ্রামের কাউকে ডুমুর ফল রেঁধে খেতে দেখতাম না। কিন্তু এই দিনে ডুমুর ফল চাই চাই ।যাইহোক হরেক পদের শাকসবজি টোকানো হত ।যেহেতু গ্রামে প্রধান পেশা কৃষি আর নানারকম গাছ-গাছড়া আছে , ১০-১২ পদের শাক-সবজি খুব সহজেই পাওয়া যেত ।তারপর সেগুলো একসাথে মিলিয়ে ডালের মত বিশেষ এক প্রকার ঝোল বানানো হত । মুরুব্বীরা এই কাজকে খুব উৎসাহ দিত ,আমরাও খুব মজা পেতাম ।পাশাপাশি এই ঝোল খেতে খুব তাগেদা দিত ,এই দিনে এই ঝোল খেলে নাকি শরীরে রক্ত হয় (কুসংস্কার টাইপের কিছু কথা আর কি) । রক্ত হোক আর নাহোক খুব মজা করেই খেতাম । এই দিনে আরেকটা ব্যাপার ছিল ,আমিষ খাওয়া যাবেনা ।

কেন যাবেনা সেটার সঠিক উত্তর জানা নেই । তবে এই প্রথাটা নিঃসন্দেহে হিন্দু-ধর্মাবলি লোকদের কাছ থেকে এসেছিল ।এখনও আমাদের গ্রামে কিছু লোকজন হারইনের দিন পালন করে আসছে ।যদিও কিছু কুসংস্কারচ্ছ্বন্ন ছিল ,তবুও মাটির সংস্কৃতির খুব অভাব বোধ করি এখন । পহেলা বৈশাখের দিন মেলা হইত ,ঘোড়ার দৌড় হত ।পহেলা বৈশাখে শুরু হয়ে তিনচার দিন পর্যন্ত চলত ।ব্যাপারটা ছিল আজ এই এলাকার মেলা পরের দিন অন্য এলাকায় পরশু আবার পাশের এলাকায় ।মেলার প্রধান আকর্ষন থাকত ঘোড়ার দৌড় ।ঘোড়ার দৌড়ের পিছনে আবার একটা ইতিহাস আছে ।ঘোড়ার দৌড়ের জন্য বড় বড় মাঠ/ক্ষেত বেছে নেয়া হত যেখানে ধান চাষ করা হত । ধারনা করা হত ঘোড়ার দৌড় হলে নাকি ধান ভাল হয় (কুসংস্কার ) ।

এখনো মেলা ঘোড়ার দৌড় হয় ,তবে আগের চেয়ে অনেক কম ।মেলায় যেতাম,তবে মায়ের কাছ থেকে অনেক কাকুতি মিনতি করে । তারপর আবার আছে আর্থিক ব্যাপার স্যাপার ।অনুমতি পাওয়া গেলেও টাকা দেয়ার জন্য আবার শূরু হত নাটক ।তখন রেগেমেগে কান্নাকাটি ভাংচুর করে ১০ টাকা বা ভাগ্য ভাল হলে ২০ টাকা পাওয়া যেত ।মেলায় গিয়ে বাদাম,বুট, মুড়লী, জিলাপী বা কিছু মিষ্টী-মন্ডা কিনে খেতাম ।আসার সময়ে ৫ টাকা দামের একটা বেলুন কিনে ফুলিয়ে আসতাম বা বাঁশি কিনে আনতাম । সব সময় ইচ্ছা হত একটা রংচঙে গাড়ি কেনার যেটার দাম ছিল ১০০ টাকার উপরে ।কোনসময়েই যেটা কেনা হয়না ।

আহা কি মধুর দিনগুলো ছিল তখন ।এখনকার ছেলেমেয়েরা এই দিনগুলোর মর্ম বুঝতে পারবেনা । পহেলা বৈশাখের সাথে আরেকোটা মজার অংশ ছিল হালখাতা ।যেসব দোকানে বাকি থাকত সেসব দোকানে কিছু টাকা জমা দিয়ে মিষ্টি,পুড়ি ,সিংগাড়া ,নিমকি খাওয়া ছিল রাজ্য জয় করার মত আনন্দ ।হালখাতা পহেলা বৈশাখে শুরু হয়ে এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলত ।একবার একটা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম । তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি হয়ত ,ঘোড়ার দৌড় শুরু হয়ে গেছে ।তাগড়া তাগড়া ৭-৮টা ঘোড়া শুরুর প্রান্ত থেকে দৌড়ে আসছে ।আমি ঠিক তখন ঘোড়া দৌড়ে এসে যেখানে থামবে সেখানে দাড়িয়ে আছি ।

দেখছি ঘোড়া দৌড়ে আমার দিকে ছুটে আসছে ।আমি হতভম্বের মত ঠায় দাঁড়িয়ে আছি ,কি করব বুঝতেছিনা । ঠিক তখনই এক লোক পিছন থেকে হ্যাঁচকা টাবে আমাকে রাস্তার উপরে টান দিয়ে তুলল । ঘোড়ার দোড় থামার শেষ বর্ডারে কিছুটা উচুঁ একটা রাস্তা ছিল ।আমাকে টান দিয়ে নেয়ার পর দেখি ,আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ।সেখানেই একটা ঘোড়া এসে দৌড় থামাল । ঘোড়ার উপর যদিও জকি হিসেবে কিশোর বয়সের ছেলে থাকত একজন ।দাঁড়িয়ে থাকলে হয়ত ভয়ংকার নাহলেও বিপদ কিছুটা হত ।এই কথা কাউকে বলিনি আজ প্রথম প্রকাশ করলাম ।

এবার আসি অন্য কথায় ।পহেলা বৈশাখের ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে দেখি ,দুইরকম মতভেদ । উইকিপিডিয়া বলছে ,”ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতেহত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার আদেশ দেন।

সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।

অন্য এক জায়গায় পেলাম (সোর্স উল্লেখ করতে চাচ্ছিনা) ; আমাদের আজকের বাংলা বর্ষ শুরু হয় ইংরেজি সনের ১৪ই এপ্রিল থেকে। আজকের বাংলা বর্ষ শুরু আর আকবরের বর্ষ শুরু মধ্যে ২৫ দিনের ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। কাজেই বাংলা সন যে আকবর বাদশাহ প্রবর্তিত আকবরী সন তা পুরো সঠিক নয়।  আকবর বাদশাহ এই ২১শে মার্চকে বছরের সূচনা হিসাবে গ্রহণ করার মূল কারণ ছিল ঐ তারিখে সে সিংহাসনে বসেছিল। তাই তো ১৫৮৪ সনে হিজরি সন থেকে আকবরি সনে মাইগ্রেট করলেও আকবর বাদশাহ তাঁর সিংহাসন আরোহণের বছরকে স্মারক করে রাখতে আকবরি সনের উৎপত্তি কালকে পিছিয়ে ১৫৫৬ সনে নিয়ে যায়। আর সেটি ঘটেছিল হিজরি ৯৬৩ সনে। তাছাড়া আকবরি সনে কোন বাংলা মাসের নাম নিশানা ছিলোনা।

পরে কোন এক সময় বাঙ্গালীরা নিজদের হিসাব নিকাশ শুভ অশুভ নির্ণয় করতে আকবরি সনের মাইগ্রেট পদ্ধতি গ্রহণ করলেও তাঁরা আকবরি সনের মাসের নামকে গ্রহণ না করে হিন্দুদের কাছে প্রচলিত মাস গুলোর নাম গ্রহণ করে। এবং এই মাস গুলো শুরু এবং শেষ হয় রাশি চক্রে সূর্যের অবস্থানের উপর। ১৫ই এপ্রিল মেষরাশিতে যখন সূর্য প্রবেশ করে তখন থেকে বৈশাখ মাসের শুরু হয়। আর এই ভাবে ভিন্ন বার রাশির উপর সূর্যের অবস্থানের উপর ভিন্ন বার মাসের নাম করণ করা হয়েছে। তাই অনেকে আকবর বাদশাহর সময় থেকে বৈশাখ মাসকে বছর শুরু দাবী অসত্য বই আর কিছু নয়। যদি সত্য হত তাহলে তো কোথাও না কোথাও লিখিত দলিল পাওয়া যেত। আমাদের ইতিহাসবিদগণকে মনে করি শব্দটি ব্যবহার করতে হতোনা।

আসলে বাংলা সন হচ্ছে হিজরি সন, ইরানীয়ান সন এবং বৈদিক সুরিয়া সিদ্ধান্তের এক মিশ্রিত সন। যা মোটেই আকবরি সন নয়। তাই এই সনের উৎপত্তিকে জাতে তোলতে কয়েক শ বছর পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে মিথ্যা আত্মপ্রসাদ লাভ করি তা অত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কি নয় বৈকি!!!

দ্বিতীয় মতবাদের যদিও তেমন মূল্য নেই কারন যিনি এই মতবাদ দিয়েছে ,তিনি কোন পরিচিত বুদ্ধিজীবী নন । তবে আমার কাছে এই মতবাদটি অযৌক্তিক মনে হয়নি । প্রথম মতবাদে অনেক কিছুই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মনে হল । যদিও এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে নেয়া হয়েছে পহেলা বৈশাখের ইতিহাস হিসেবে । আপনাদের মতামত কামনা করছি সত্যটা জানার জন্য ।

(সং গ্রহে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here