ডিপিডিসিতে অনিয়মে জড়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা,শাস্তি পাচ্ছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) মিটার রিডিং, লাইন মেরামতের কাজ করেন বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ আছে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মাধ্যমে অনিয়মে জড়ায় ডিপিডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ধরা পড়লে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সাময়িক শাস্তি দিয়ে পার পেয়ে যান মূল অপরাধীরা। কিছু দিনের মধ্যে আবারো নিয়োগ দেওয়া হয় টাকার বিনিময়ে। তদন্ত না করে এড়িয়ে যাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। মাঠ পর্যায় বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ করছে ৩৬টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এদের তদারকি করছেন স্থানীয় বিদ্যুৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

চাকরিচ্যুত হয়েও চাকরি করছেন শিফাত আলী: রাজধানীর আদাবর এলাকায় মিটার রিডারদের সুপারভাইজার শিফাত আলী। ডিপিডিসির ওই জোনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে টেকনোলজি  এনিভিশনের কর্মী তিনি । দীর্ঘ দিন ধরেই তিনি এখানে কাজ করছেন। গত বছর একই পদে কাজ করতেন মানিক নগর এলাকায়। তখন ডিপিডিসির আরেক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে ছিলেন শিফাত। ঘুষ নেওয়ার দায়ে ২০১৯ সালের আগস্টে চাকরি হারান।

জানা গেছে, জুলাই মাসে গ্রাহক আসাদ মিয়ার মিটারে ৯ হাজার ৩৪৬ ইউনিট আসে। ওই মাসে বিল ছিলো ৮০ হাজার ৮৮৮ টাকা। আগস্ট মাসে মিটারে দেখা গেছে মিটার রিডিং ছিলো ১১ হাজার ১৯৮ ইউনিট। কিন্তু আগস্ট মাসের বিলে নতুন বিল দেখানো হয় ৬০ ইউনিট। প্রায় ২ হাজার ইউনিট কম দেখানো হয়। এতে করে বিদ্যুৎ বিল কমে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ২০১ টাকায়। ওই ঠিকানায় ১২টি সিপিসি মিটার নতুন ইস্যু করা হয়। ইস্যুকৃত নতুন মিটারগুলো আগস্ট মাস দেখানো হয়। গ্রাহক আসাদ মিয়ার মিটারে বিশাল অংকের বকেয়া থাকলেও বকেয়া লেজারটি নতুন মিটার ইস্যুর সময় নথিতে উল্লেখ করা হয়নি। শিফাত আলী গ্রাহকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সুবিধা নিয়ে এই জালিয়াতি করেছেন বলে তদন্তে বেড়িয়ে এসেছে।

মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্ত্বাধিকারী হেলাল উদ্দিন বলেন, যাকে আমরা নিয়োগ দিয়ে ডিপিডিসিতে পাঠাই, তাদের কাজ করানো এবং কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব ডিপিডিসির। যদি কেউ অনিয়ম করে সে বিষয়ে আমাকে চিঠি দিয়ে জানাবেন। আমরা ব্যবস্থা নেবো। আদাবর জোনের তত্ত্বাধায়ক প্রকৌশলী (এসি) রুহুল আমিন বলেন, লাইনম্যান শিফাতকে অফিসে আসতে মৌখিকভাবে নিষেধ করা হয়েছে। ডিপিডিসির প্রধান কার্যালয়ে জানানো হয়েছে। সেখানকার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে শিফাতের চাকরি। তবে তার সম্পর্কে বিস্তারিত আগে জানাছিলো না। 
৬৮ দোকান থেকে ১০ লাখ টাকার বিদ্যুৎ চুরি: ফার্মগেটের সাউদিয়া সুপার মার্কেটে ৬৮টি দোকানে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এই দায়ে জানুয়ারিতে দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে ডিপিডিসি। টাস্কফোর্স তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, গ্রাহককের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন ডিপিডিসির কাকরাইল দফতরের মিটার রিডার মফিজুল ইসলাম।
তার বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে ডিপিডিসি। তবে এই লাইনের ফিডার ইনচার্জ সহকারী প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত করেনি প্রতিষ্ঠানটি। তিনি ডিপিডিসির ২৮ হাজার ২৮০ ইউনিট বিদ্যুৎ গায়েব করেছেন, যার মূল্য ৯ লাখ ১৭ হাজার ৫৪৪ টাকা।
টাস্কফোর্স প্রতিবেদনে বলা হয়, ফার্মগেটের সাউদিয়া সুপার মার্কেটের গ্রাহক সিদ্দিকুর রহমান মিটার টেম্পারিং করে বিদ্যুৎ চুরি করে আসছেন। এতে সহযোগিতা করেছেন কাকরাইলের মিটার রিডার জহিরুল। যার বিনিময়ে প্রতি মাসে পেতেন ২০ হাজার টাকা। পরবর্তীতে কাকরাইল দফতরের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান টাঙ্গাইল বৈদ্যুতিক বাণিজ্য সংস্থার মিটার রিডার মোঃ মাজেদুর রহমান প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিদ্যুৎ চুরিতে সহায়তা করতেন। অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কারণে মিটার রিডার মোঃ মাজেদুর রহমান ও জহিরুলের বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। গত ১৩ জানুয়ারি ডিপিডিসির স্পেশাল টাস্কফোর্স আহবায়ক ও কোম্পানি সচিব মো: আসাদুজ্জান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এসব কথা উল্লেখ করেন।
কাকরাইল ডিভিশনের ফিডার ইনচার্জ সহকারী প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন বলেন, এই চুরির সঙ্গে আমি জড়িত নই। এর দায়ভার লাইনম্যান মেটের। আর সে যদি চুরি করে সেখানে আমাদের কি করার আছে। সাউদিয়া মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক মো: সিদ্দিকুর রহমান বলেন, লাইনম্যান বিদ্যুৎ চুরিতে সহায়তা করেছে। ফিডার ইনচার্জ জানে কিনা আমার জানা নেই। আমি লিখিতভাবেই জবাব দিয়েছে।
নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) ও অতিরিক্ত দায়িত্ব নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) মো: গিয়াস উদ্দিন জোয়ার্দার বলেন, ফিডার ইনচার্জ চুরিতে জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। লাইনম্যান শিফাতের বিষয় খোঁজ খবর হচ্ছে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া যারা বিদ্যুৎ চুরির সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 
কাকরাইল ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: হানিফ বলেন, লাইন ফিডার ইনচার্জ সহকারী প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। তিনি একা দায়িত্ব থাকার কারণে লাইনম্যানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তাই লাইনম্যান সঠিকভাবে তথ্য না দেওয়ার কারণে এই সমস্যা হয়েছে।
১০ কর্মকর্তার রদবদল: গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারি ডিপিডিসির ১০ কর্মকর্তাকে রদবদল করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (এইচ.আর) নীহার রঞ্জন সরকার স্বাক্ষরিত এক আদেশে এই বদলি করা হয়েছে। বদলি হওয়া কর্মকর্তার মধ্যে কয়েক জনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করে নাগরিক বার্তা। এর পরে তদন্ত শুরু করেন ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বদলি করা ১০ কর্মকর্তার মাঝে কয়েকজনকে নিয়মিত বদলি করা হয়েছে এবং সংবাদে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দাপ্তরিক অ্যাকশন হিসেবে বদলি করা হয়েছে।
এমপ্লয়ি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ডি.জি.এম (এইচ.আর) মো: হজ্জত উল্যাহকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন, ডিজিএম(এইচ.আর) সিটিউরিটি এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী চুক্তি ও ক্রয় (অতি: দায়িত্ব) ম্যানেজার (এইচ.আর) মো: জাহাঙ্গীর আলমকে প্রজেক্ট ডিরেক্টর, এক্সপানশন এন্ড স্ট্রেন্দেনিং অব পাওয়ার সিষ্টেম নেটওয়ার্ক আন্ডার ডিপিডিসি (জিটুজি), ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যানিং (সেন্ট্রাল) নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মমিনুল ইসলামকে সিস্টেম প্রটেকশন (সাউথ)নির্বাহী প্রকৌশলী, প্রশিক্ষণ উন্নয়ন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: শাহ আলম মিঞাকে ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যানিং (সেস্ট্রাল), নির্বাহী পরিচালক, প্রকৌশলী মোহাম্মদ শের আলীকে নির্বাহী প্রকৌশলী এনওসিএস, আদাবর, এনওসিএস সাউথ প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল আলমকে নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশল, আদাবর এনওসিএস নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানকে সিস্টেম প্ল্যানিং নির্বাহী প্রকৌশলী, স্টোর ম্যানেজমেন্ট নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী সাইদুর রহমানকে নির্বাহী প্রকৌশলী এনওসিএস জুরাইন, এনওসিএস নর্থ প্রধান প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরিকে নির্বাহী প্রকৌশলী স্টোর ম্যানেজমেন্ট ডেবেলপমেন্ট, নির্বাহী প্রকৌশলী এনওসিএস জুরাইন মেজবা উদ্দিন সিকদারকে নির্বাহী প্রকৌশলী আন্ডার গ্রাউন্ড ক্যাবল (নর্থ) পদে বদলি করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান চাকমা নাগরিক বার্তাকে বলেন, অভিযোগ পেলেই তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযুক্ত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ডিপিডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। তথ্য যাচাই বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে।  

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here