প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ পীর আবদুল মান্নান: তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিদের গুরুত্বপূর্ণ বয়ান ও মুসল্লিদের নফল নামাজ, তাসবিহ তাহলিল, জিকির আসগারের মধ্যদিয়ে শনিবার বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। আজ রবিবার পূর্বাহ্নে অর্থাৎ সকাল ১১ থেকে ১২টার মধ্যে যেকোনো এক সময় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত আখেরি মোনাজাত কাকরাইল জামে মসজিদের পেশ ইমাম ও খতীব হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আহমেদ পরিচালনা করার কথা রয়েছে।
তাবলীগের ৬ উসূলের (মৌলিক বিষয়ে) উপর বাদ ফজর ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমানের বয়ানের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দিনের বয়ান শুরু হয়। এ বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল মতিন। বাদ জোহর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইসমাইল গোদরা। তার বয়ান ভাষান্তর করেন মাওলানা মো. নূর-উর-রহমান। বাদ আছর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা জোহায়েরুল হাসান। বাদ মাগরিব বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহীম দেওলা। এবার ইজতেমা ময়দানে যৌতুক বিহীন বিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব ইজতেমার শীর্ষ জিম্মাদার প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান।
দ্বিতীয় দিনেও ইজতেমাস্থলে মুসল্লিদের আগমন অব্যাহত থাকে। বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে শিল্পনগরী টঙ্গী এখন ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ আগমন ঢল অব্যাহত থাকবে। আজ আখেরি মোনাজাতে বেশ কয়েকজন ভিআইপি অংশগ্রহণ করবেন বলে বিশেষ সূত্রে জানা গেছে।
মুরব্বিদের বয়ান চলাকালে পুরো ইজতেমা ময়দান জুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। সকালের ঠান্ডা বাতাস ও কনকনে শীত উপেক্ষা করে মুসল্লিদেরকে অধিক মনযোগ সহকারে মুরব্বিদের মূল্যবান বয়ান শুনতে দেখা গেছে। শুক্রবার রাত থেকে গতকাল শনিবার বিকেল পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে ৫ জন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এনিয়ে এপর্যন্ত ইজতেমায় ৯ জন মুসল্লি মারা গেছেন।
মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বয়ান : গতকাল বাদ ফজর ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমান ইমান, আমল, জাহান্নাম, জান্নাত ও দাওয়াতে মেহনতের উপর গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন। তিনি তাঁর বয়ানে বলেন, আমাদের জানমাল দ্বীনের দাওয়াতের কাজে ব্যয় করতে হবে। তিনি বলেন, ঘর তৈরি করতে গেলে যে পরিমান মেহনত করা প্রয়োজন, আমরা সে পরিমান মেহনত করলে একটি ঘর তৈরি হয়। ঠিক একইভাবে দাওয়াতের কাজে যে পরিমান মেহনত করা প্রয়োজন, সে পরিমান মেহনত করলে আল্লাহজাল্লাহ শানহু আমাদের দাওয়াতকে কবুল করবেন। আর দাওয়াত কবুল হলে আমাদের দোয়া কবুল হবে। দোয়া কবুল হলে আমাদের জীবন পরিবর্তন হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, উম্মতকে যে জিম্মাদারি দেয়া হয়েছে তার মূল্য সাহাবায়ে আজমাঈন বুঝতেন। তাই তারা সর্বদিকে এই দাওয়াতের জিম্মাদারি পৌছে দেয়ার জন্য পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণসহ সারা দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়তেন। সাহাবায়ে আজমাঈনগণ তাদের জান ও মাল দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করতেন। তাই আল্লাহজাল্লাহ শানহু প্রতি কদমে কদমে তাদের সাহায্য করতেন। আল্লাহ তাদের দাওয়াতের মাধ্যমে দেশের পর দেশ জয় করে দিয়েছেন। যেদিকে তারা মেহনত করেছেন আল্লাহ তায়ালা সেদিকে হেদায়েত পৌছে দিয়েছেন; যেদিকে উনাদের জান ও মাল লাগিয়েছেন সেদিক আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার মধ্যে হেদায়েতকে সহজ করে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ঈমান এবং আমল। ঈমান ও আমলের উপর আল্লাহজাল্লাহ শানহু দুনিয়ার শান্তির ব্যবস্থা করেন।
ঈমান ও আমল দ্বারাই দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবী হাসিল হয়। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর কাছে ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণযোগ্য না। ইসলামই আল্লাহপাকের নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন এবং রাস্তা। আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলাম শুধু আমাদের জন্য না এটা পুরো দুনিয়ার মানব জাতির জন্য। সেজন্য ইসলামকে শুধু আমাদের মধ্যে রাখলে জিম্মাদারি আদায় হবে না। ইসলামকে সারা দুনিয়ায় মানুষের মাঝে পৌছানো। একেক জন মানুষকে ইসলামে দাখিল করা এবং নাফরমানি থেকে বাঁচানো এটাও আমাদের উপর বড় জিম্মাদারি। তিনি বলেন, যার কাছে ধনসম্পদ নেই, আমরা তাকে মিসকিন বা ফকির বলি।
কিন্তু প্রকৃত মিসকিন বা ফকির হলো সেই ব্যক্তি যার কাছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (সা.) মানে কলেমা নাই সেই প্রকৃত ফকির। যার কাছে বেহেশতে যাওয়ার সামানা নাই, সেই হলো প্রকৃত ফকির। যার মধ্যে কলেমা আছে সেই ধনী ও ভাগ্যবান। তিনি বলেন, দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের কাছে কলেমার দাওয়াত পৌছানো আমাদের দায়িত্ব। কালেমা ছাড়া কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না।
বিশ্ব ইজতেমায় আরো ৫ মুসল্লির মৃত্যু: গত শুক্রবার রাত ও গতকাল শনিবার বিকেল নাগাদ ময়দানে আরও ৫ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এনিয়ে ইজতেমা ময়দানে ৯ মুসল্লির মৃত্যু হলো। তারা হলেন-রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার বন কিশোর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক (৬৫), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থানার বড়তল্লা গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে শাহজাহান (৬০), কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার ভিংলাবাড়ি গ্রামের আব্দুস সোবহানের ছেলে তমিজ উদ্দিন (৬৫), শনিবার সকালে মারা গেছেন বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার খালিজপুর এলাকার আলী আজগর (৭০) ও নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার দক্ষিণ কলাবাগান এলাকার মো. ইউসুফ আলী মেম্বার (৪৫)।
এর আগে শুক্রবার সকালে নওগাঁর শহিদুল ইসলাম (৫৫), বৃহস্পতিবার সকালে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া এলাকার ইয়াকুব শিকদার (৮৫), বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সিরাজগঞ্জের খোকা মিয়া (৬০) এবং চট্টগ্রামের মুহাম্মদ আলী (৭০) মারা যান। বিষয়টি ইজতেমা ময়দানের মাসলেহাল জামাতের জিম্মাদার মো. আদম আলী নিশ্চিত করেছেন।
যৌতুকবিহীন বিয়ে : ইজতেমা ময়দানের শীর্ষ মুরুব্বি প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান বলেন, গতকাল শনিবার বাদ আসর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের মূলমঞ্চে ১০০ জোড়া যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিয়ে পরিচালনা করেন মাওলানা জোহায়েরুল হাসান। তাবলিগের রেওয়াজ অনুযায়ী ইজতেমার দ্বিতীয় দিন বাদ আসর বয়ান মঞ্চের পাশে বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর। কনের সম্মতিতে বর ও কনে পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে ওই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হয় ‘মোহর ফাতেমী’র নিয়মানুযায়ী। এ নিয়ম অনুযায়ী মোহরানার পরিমাণ ধরা হয় দেড়শ’ তোলা রূপা বা উহার সমমূল্য অর্থ।
বিয়ের পর নব-দম্পতিদের সুখ-সমৃদ্ধিময় জীবন কামনা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে মোনাজাতের মাধ্যমে দোয়া করা হয়। এসময় মঞ্চের আশপাশের মুসল্লি¬দের মাঝে খুরমা খেজুর ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়। উল্লেখ্য, গত ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে যৌতুক বিহীন বন্ধ ছিল। তবে বর ও কনে পক্ষের সম্মতিতে তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকার মসজিদে যৌতুক বিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল।
ময়দানে চারপাশে ময়লা আর্বজনার স্তুপ : ময়দানের উত্তর-পূর্ব পাশসহ আশপাশে মুসল্লিদের ফেলা ময়লা আর্বজনার স্তুপ পড়ে রয়েছে। এতে সাধারণ মুসল্লিদের চলাচলে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
ইজতেমায় বিদেশি মুসল্লিদের অংশগ্রহণ: ইজতেমার প্রথম পর্বে সৌদি আরব, জর্ডান, মিসর, ওমান, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, কাতার, কানাডা, কম্বোডিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানী, ইরান, জাপান, মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, পানামা, সেনেগাল, রাশিয়া, আমেরিকা, জিম্বাবুয়ে, বেলজিয়াম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, আফগানিস্তান, থাইল্যান্ড, কুয়েত, মরক্কো, কাতার, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, ইরিত্রিয়া, মৌরিতানিয়া, ভারত, দুবাইসহ বিশ্বের ৬২ দেশের প্রায় ২ হাজার ৪শ’ মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন ভাষা-ভাষী ও মহাদেশ অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশি মেহমানদের ভিন্ন ভিন্ন তাবু নির্মাণ করা হয়েছে।
ইজতেমায় মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যা ঃ শনিবার ইজতেমা ময়দান ও টঙ্গী থেকে কোন মোবাইলেই দেশের বিভিন্নস্থানে নেটওর্য়াক যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। মাঝে মধ্যে লাইন পেলেও মুহূর্তেই কেটে যাচ্ছিল। মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলো নেটওয়ার্ক সুবিধা দিতে ইজতেমা উপলক্ষে ময়দানের আশপাশ এলাকায় অতিরিক্ত মোবাইল টাওয়ার সংযোগ করেও এ সমস্যার পুরো সমাধান দিতে পারেনি।
খাস বয়ান ও খুসুশি বয়ান : গতকাল সকাল ১০টায় বিভিন্ন এলাকায় থেকে আগত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে খাস বয়ান করে ভারতের মাওলানা ইব্রাহীম দেওলা। তিনি বয়ান মঞ্চের সামনে উপস্থিত শিক্ষকদের বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় বের হওয়ার উপর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন। এদিকে ময়দানে স্থাপিত নামাজের মিম্বার থেকে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে খুসুশি বয়ান পেশ করা হয়। খুসুশি বয়ান পেশ করেন ভারতের মাওলানা আহমদ লাট।
বধিরদের জন্য বয়ান : বিশ্ব ইজতেমায় আগত বধির (কানে শোনে না এমন) মুসল্লি¬দের জন্য তুরাগ নদের পশ্চিম পাড়ে নির্ধারিত খিত্তায় জামাতবদ্ধ করে বয়ান শোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে বয়ান বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে।
আয়োজক কমিটির বক্তব্য : ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান বলেন, ময়দানে আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকায় পরিচ্ছন্নভাবে বিশ্ব ইজতেমা পালিত হচ্ছে। ময়দানে আগত দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি স্বাচ্ছন্দে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল রয়েছে। ইনশাআল্লাহ, আজ সকাল ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে ইজতেমা শেষ হবে।