ইফতারিতে ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে সয়লাব হয়ে রয়েছে বাজার।

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ পীর আবদুল মান্নান: আজ শুরু হয়েছে মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাস রমজান। দিনভর রোজা শেষে ইফতারিতে ভাল-মন্দ খেতে চান রোজাদাররা। বিশেষ করে ইফতারির অপরিহার্য উপকরণ ছোলা, মুড়ি, পিয়াজু, বেগুনি, জিলাপি, খেজুর-খোরমা, হালিমের মতো খাবারের বেশি চাহিদা বাংলাদেশে। কিন্তু ইফতারির এ উপকরণগুলো কতটা নিশ্চিন্তে খেতে পারবেন-তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে রোজাদারদের মনে।

কারণ ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে সয়লাব হয়ে রয়েছে বাজার। ফলে ভেজালমুক্ত ইফতার আশা করাটাই এখন রীতিমতো অতি আশায় পরিণত হয়েছে। যে মুড়ি ছাড়া ইফতার অকল্পনীয় সেই মুড়িকে সাদা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে ট্যানারিতে ব্যবহার্য বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। বড় বড় দানার মুড়ি তৈরি করা হয় রাসায়নিক সার দিয়ে। জিলাপি দীর্ঘক্ষণ মচমচে রাখতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে পোড়া মবিল। বেগুনি, পিয়াজু, চপ ইত্যাদি তেলেভাজা ইফতারিসামগ্রী আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হয় কেমিক্যাল রং।

ভাজাপোড়ায় ব্যবহৃত তেল কতদিন ধরে কড়াইয়ে ফুটতে থাকে তার কোনো ইয়াত্যাই নেই। ইফতারির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও অপরিহার্য অনুষঙ্গ খেজুরেও এখন বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে রোজাদারদের। কারণ মেয়াদোত্তীর্ণ, পচা দুর্গন্ধযুক্ত খেজুরে বাজার সয়লাব হয়ে আছে। কার্বাইড বা ফর্মালিন মেশানো ফলমূলও এখন বড় আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।

যদিও রোজার মাসে খাদ্যে কোনো ধরনের ভেজাল সহ্য করা হবে না বলে ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। গত ৩০ এপ্রিল নগরভবনে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, খাদ্যে ভেজাল রোধে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার পাঁচটি অঞ্চলে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। কিন্তু পর্যাপ্ত ও আশানুরূপ কোনো অভিযানই চোখে পড়েনি বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন এলাকার ভোক্তারা।

বিএসটিআইয়ের ভেজালবিরোধী অভিযান জোরদার করা হবে বলে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। বিএসটিআইয়ের বিশেষ কার্যক্রম নিয়ে গত ২ মে শিল্প মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বিএসটিআই প্রতিবছর রমজান উপলক্ষে ভেজালবিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে থাকে। এবারও রজমান মাসে জনসাধারণ যাতে মানসম্পন্ন খাদ্য ও পানীয় পেতে পারে তার নিশ্চিত করার জন্য এ ধরনের অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।’ অসাধু ব্যবসায়ীরা ফন্দিফিকির নজরে এলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

বিএসটিআই মহাপরিচালক মো. মুয়াজ্জেম হোসাইন জানান, ইফতারে ব্যবহৃত খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং আমদানির ওপর মাসজুড়ে নজরদারি থাকবে। এসব পণ্যর গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে ভেজাল পণ্যের বাজারজাতকণ, পচা, নোংরা, মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার বিক্রির অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয় রোজার মাসেই। অধিকাংশ ইফতারি বিক্রি হয় ফুটপাতে। আর সে ফুটপাতের ৯০ ভাগ ইফতারিই ভেজাল বলে মনে করছেন বিভিন্ন অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তারা।

অসাধু ব্যবসায়ী চক্র প্রতিবছরের মতো এবারও ভেজাল পণ্য বাজারজাতকরণে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রোজার আগেই মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসটিআই এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিচালিত অভিযানে ধরা পড়েছে অনুমোদনহীন, নকল ও ভেজাল পণ্য। বিশেষ করে মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার, ফরমালিন মিশ্রিত শাকসবজি, পচা মাছ-মাংস, খেজুর, সেমাই, ঘি, তেল, ছোলা-বুটসহ নানা ভোগ্যপণ্যের মজুদ মিলেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গুদামে। ফলে গোটা রোজার মাসে ভেজাল আতঙ্কে থাকতে হবে রোজাদারদের। যদিও ভোগ্যপণ্যের ভেজাল রোধে কড়া অবস্থানে রয়েছে প্রশাসন। এর পরও প্রতিদিনই অভিযানে জব্দ হচ্ছে ভেজাল ও নকল পণ্য।

রোজাকে সামনে রেখে খাদ্যে ভেজালদানকারী ও মজুদদার চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্র। রোজাকে কেন্দ্র করে শুধু রাজধানী ঢাকা নয় দেশের বিভিন্ন হিমাগারে পাওয়া যাচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ, নষ্ট ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যসামগ্রী। প্রশাসনের চোখ এড়াতে রাজধানী ছাড়িয়ে মফস্বলের হিমাগারেও মজুদ করে রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ নষ্ট খেজুর, মিষ্টি, ফল ও মাংস। কম দামে নিম্নমানের এসব খাবার কিনে রমজানের সময় চড়া দামে বাজারে ছেড়ে উচ্চ মুনাফা লাভের মতলবে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র এ অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন অভিযানে আটকও হয়েছে ভেজাল ও নষ্ট খাদ্যসামগ্রীর বিশাল বিশাল মজুদ। অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রোজাকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের নিম্ন ও বিপজ্জনকমানের প্রচুর খাদ্য গুদামজাত করেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, ভৈরবসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যসামগ্রী জব্দ করে নষ্ট করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের নেতারা বলছেন, প্রশাসনের গতানুগতিক অভিযানে ভেজালের অপ্রতিহত গতি থামানো যাবে না। প্রয়োজন সাঁড়াশি তল্লাশি।

ভুক্তভোগী ভোক্তাদের অভিযোগ, রমজান মাসকে সামনে রেখে শহর-গ্রাম সর্বত্র বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন নকল খাদ্যপণ্যে সয়লাব। ঘি, মসলা, সেমাই, হোটেল রেস্তোরাঁয় নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভেজাল, পচা-বাসি খাবার পরিবেশন, ফরমালিন ও সার মিশ্রিত মাছ, ফলমূল-শাকসবজিতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো, ওজনে কম দেওয়া, গরুর মাংস বলে মহিষের মাংস বিক্রি, রাস্তার ওপর খোলা ইফতারি বিক্রি, বিএসটিআইয়ের সিল ছাড়া বাটখারা ব্যবহার করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষের জনজীবন মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

ফলমূল ও মাছে ফরমালিন, সার মিশ্রণ, ফল-শাকসবজিতে ফরমালিনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল মেশানোর কারণে বাজারের কোনো কিছুই এখন মানুষ নিরাপদে-নির্ভয়ে খেতে পারছে না। রোজার মাসে মানুষ সারা দিন পানাহার থেকে বিরত থেকে সন্ধ্যার ইফতারি ও রাতের সাহরিতে ভালো-মন্দ কিছু খেতে চায়। কিন্তু ভেজাল ও নকল পণ্যে বাজার সয়লাব হওয়ায় নির্বিঘ্নে রোজা রাখাও দায় হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের।

রোজার মাসে ইফতারিতে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে খেজুরের। একশ্রেণির পচা মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর বাজারজাত করে রীতিমতো জিম্মি করে তুলেছে সাধারণ রোজাদারদের। গত মাসের শেষদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন গুদাম থেকে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর জব্দ করেছে। এসব পচা ও নষ্ট খেজুর নতুন প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করা হচ্ছিল। এসব পণ্যের গায়ে নতুন করে মেয়াদের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানো আরও দুই বছর মেয়াদ দেখানো হয়। ৩১ এপ্রিল বাদামতলীর একটি প্রতিষ্ঠান থেকেই ৪১২ মণ নষ্ট খেজুর উদ্ধার করা হয়। ফলে রমজান মাস যতই এগিয়ে আসছে ভোক্তাদের মধ্যে ততই শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। কারণ এই এক মাসেই ৩৫ হাজার টন বা তারও বেশি খেজুর সাধারণ মানুষ খায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here