থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে পীরগঞ্জে

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে রংপুরের পীরগঞ্জ রামনাথপুর ইউনিয়নের তিন গ্রামে। দুর্বৃত্তের আগুনে পুড়ে গেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ২৫টি ঘরবাড়ি। মন্দিরে ভাঙচুরসহ ঘরবাড়ি-দোকানপাট লুটপাট করা হয়েছে। এক রাতেই নিঃস্ব হয়ে গেছে পরিবারগুলো। এখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিনযাপন করছেন তারা। গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে দুঃসহ রাতের বর্ণনা দিতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। বিনা অপরাধে ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের বিচার চেয়েছেন তারা।

ফেসবুকে কিশোর পরিতোষ রায়ের একটি ধর্মীয় উস্কানিমূলক ছবি পোস্ট করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রবিবার রাতভর রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মাঝিপাড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে এ খবর লেখা পর্যন্ত ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত ৪২ জনকে আটক করা হয়েছে।

ওই ঘটনাস্থল রংপুরে পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের উত্তর করিমপুর কসবা মাঝিপাড়াসহ আশপাশ গ্রামগুলোতে পুলিশ, র‌্যাব,বিজিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দাসংস্থা মোতায়েন করে সেখানে চিরুনী তল্লাশি চালানো হচ্ছে।  এদিকে জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িছে। তাদের মাঝে খাবার,পরিধেয় বস্ত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ করছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ ও আইন-শৃঙখলা বাহিনীর সূত্র জানায়, ফেসবুকে পবিত্র কাবাঘরের অবমাননাকর পোস্টটি দেয় রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামের প্রসেনজিত রায়ের ছেলে পরিতোষ রায়। ঘটনাটি পীরগঞ্জ থানায় জানিয়ে পরিতোষকে গ্রেফতারের দাবি করে স্থানীয়রা। এ নিয়ে রবিবার বিকেল থেকে উত্তেজনা চলছিল ওই এলাকায়। থানা পুলিশ সম্ভাব্য অপ্রতিকর ঘটনা এড়াতে পৌর মেয়র, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ পরিতোষের বাড়িতে অবস্থান নেয়। বিক্ষুব্ধ জনতাও ঘিরে ফেলে বাড়ি।

এর আগেই  সপরিবারে পালিয়ে যায় পরিতোষ। রাত ৯ টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত তার বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে করিমপুর-কসবা-মাঝিপাড়া এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালায়। বাড়ির সামনে এবং রাস্তার ধারের অনেক খড়ের গাঁদায় ও ১৮টি ঘর ও একটি দোকানে দেয়া হয় আগুন। আগুনে পুড়ে যায় সুমতি রানীর গরু, প্রদীপ চন্দ্রের ভ্যানসহ থাকার ঘর। পুড়ে ছাই হয়ে যায় নিখিলের দোকান। অনেক বাড়িতে চালানো হয় ভাঙচুর। লুটকরা হয় গুরু, ঘরের আসবাবপত্রসহ মালামাল। আতংকে নারী ও পুরুষ অনেকেই আশ্রয় নেন পাশের ধানক্ষেতসহ বিভিন্ন জায়গায়। ভাঙচুর করা হয় মন্দিরের প্রতিমা।

ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সেখানে ফাঁকা গুলি ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। রাত ১ টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পুরো ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সেখানে রাতভর উপস্থিত থাকেন রংপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ। আটক করা হয়েছে ৪০ জনকে। উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সকালে ও দুপুরে খাবার বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য। এছাড়াও এঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

রংপুর পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার জানান পরিতোষ নামের ১৫-১৬ বছরের ছেলে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট দিয়েছিল। সেই পোস্টটিকে কেন্দ্র করে সন্ধ্যার পরপর অসংখ্য লোকজন উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং পরিতোষের বাড়ি আক্রমনের জন্য সমবেত হতে থাকে। এই খবর পাওয়া মাত্রই ওসির নেতৃত্বে পুলিশ ফোর্স এবং ইউএনও এর নেতৃত্বে উপজেলা প্রশাসনের লোকজন সেখানে আসে। আমরা খবর পেয়ে আমরা অতিরিক্ত ফোর্স পাঠিয়েছি এবং ডিসি সাহেব খবর পেয়ে ডিসি সাহেবসহ অন্যান্যরা এসেছেন। তখন আমরা সবাই মিলে পরিতোষের বাড়ির আশেপাশের পরিবেশ অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবিবার রাত ১০টায় তাণ্ডবের খবর পেয়ে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। দমকলের ৫টি ইউনিট যখন একদিকে আগুন নেভানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তখন আরেক দিকে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন হামলাকারীরা।  চোখের সামনে দাউ দাউ করে ছড়িয়েপড়া আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যায় বেশকিছু ঘরবাড়ি ও দোকান। গবাদি পশুগুলো লুট হয়ে যাওয়ায় আহাজারি আর আর্তচিৎকারে ভারি হতে থাকে রাত।

ঘটনার পরপরই রংপুরের পুলিশ সুপার, র‌্যাব-১৩-এর অধিনায়ক, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। রাত ১টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পুরো ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সেখানে রাতভর উপস্থিত থাকেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিরোদা রানী রায় জানান, রবিবার রাতে উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের বটেরবাজার মাঝিপাড়ায় সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে আরো সময় লাগবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, যার নেতৃত্বে এই হামলার ঘটনা ঘটেছে তাকে পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সে একটি দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা বলে জানান তিনি। তবে কারো নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ।

এদিকে এ ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে রংপুর নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্রলীগ। রংপুরের পীরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলা, ভাঙচুরের প্রতিবাদে উতপ্ত হয়ে রংপুর নগরীর রাজপথ। রবিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন সংগঠন মন্দিরে হামলা, পূজামন্ডপ ভাঙচুর, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ লুটপাটের প্রতিবাদে নগরীতে মিছিল সমাবেশ করে।

সোমবার সকালে রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে সবচেয়ে বড় মানববন্ধনও সমাবেশ করে ইসকন, পুজা উদ্যাপন পরিসদ ও বাংলাদেশ হিন্দু, খ্রিষ্টান বৈদ্ধ ঐক্য পরিষ্দ। এতে নগরীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত নারী, পুরুষ ও শিশু তাদের নিরাপত্তা চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন।

ঘটনা স্থল পরিদর্শন করে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল ওয়াহাব ভুঞা জানান, ক্ষতিগ্রস্থদের দ্রুত পুর্নবাসনসহ সকল ধরনের সহযোগিতা করা হবে। আমারা চাই এখানকার মানুষ একে অপরের সাথে শান্তিতে বসবাস করুক। যারা দোষি তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবেনা বলে জানান এই কর্মকর্তা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here