এক যুগ ধরে কমিটি জটিলতায় জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ মেয়াদোত্তীর্ণ বিএনপির ঢাউস নির্বাহী কমিটি ও ঢাকা মহানগর দুই শাখার কমিটি, মুখ থুবড়ে পড়েছে জেলাগুলোও বিগত ২০০৯ সালের পর অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি বিএনপি। এর মধ্যে কয়েক দফায় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিছুটা এগিয়েও সফলতা আসেনি। ৮২টি সাংগঠনিক জেলার কমিটি করতে গিয়ে ২০১৬ সালে বেশ কিছু জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিয়েছিল দলটি। এরপর ২০১৯-২০২০ সালে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই তৃণমূলের কমিটি পুনর্গঠনে চেষ্টা চালান।

পুরনো কমিটি ভেঙে ৩৭টি জেলায় আহ্বায়ক কমিটিও করে দেন তিনি। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে দুই চারটি জেলা ছাড়া সবগুলোতেই ব্যর্থ হন তারা। ২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থবির প্রায়। এখনো বিএনপির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম চলছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে অগোছাল রয়ে গেছে দলটি।

কার্যত এক যুগ ধরেই কমিটিজটে বিএনপি। প্রায় আড়াই বছর ধরে কারাবন্দী দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। দলের কেন্দ্রীয় ৫০২ সদস্যের ‘ঢাউস’ নির্বাহী কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ দুই বছর ধরে। বিএনপির স্থায়ী কমিটিসহ নির্বাহী কমিটিতে অর্ধশত পদ শূন্য। খালেদা জিয়া-বিহীন বিএনপি এখন কমিটিও করতে পারছে না কিংবা নির্বাহী কমিটির শূন্য পদগুলোও পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে ঢাকা মহানগর বিএনপির দুই শাখাও। বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে দু-একটি বাদে সবগুলোই এখন অকার্যকর। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলে একদিকে যেমন নেতৃত্বশূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে বিএনপির গতিশীলতায়ও ভাটা পড়েছে। হতাশা আর মামলায় জর্জরিত হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও।

জানা যায়, ২০১৯-২০২০ সালে তারেক রহমান যাদের কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেন, বিশেষ করে সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক পর্যায়ের নেতাদের, তারা ঢাকায় বসেই নিজস্ব বলয়ের নেতাদের কমিটিতে নিয়ে আসার জোর চেষ্টা চালান। কমিটি গঠন করতে হলে যে বিবদমান সব গ্রুপের সঙ্গে কথা বলা, এলাকায় কর্মিসভা করা বা সবার মতামত নেওয়া তার কোনোটাই করেননি অধিকাংশ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা। এরপর যেসব জেলায় আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়, সেখানে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বড় অংশই প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন।

এ কারণে অধিকাংশ জেলার আহ্বায়ক কমিটির নেতারা আর বেশিদূর এগোতে পারেননি। এখন ওইসব জেলায় বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও বেড়েছে কোন্দল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভোটবিহীন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। এর মধ্যে আমাদের চেয়ারপারসনও কারাবন্দী। তারপরও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটি দলের হাল ধরেছে। দল গোছানোর কাজও চলছে।

নতুন নির্বাচন ও গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে আমাদের আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। সেই লক্ষ্যেই আমরা সভা-সমাবেশ ও সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তারেক রহমানের নেতৃত্বে এখন সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রম চলছে। করোনা ও প্রতিকূল অবস্থায়ও দল গোছানোর কাজ আমরা অনেক দূর এগিয়েছি।’ জানা যায়, বিএনপির নতুন ৩৭টি সাংগঠনিক জেলার আহ্বায়ক কমিটিতে নাজুক অবস্থা। কোনো জেলাকে এক মাসের বা তিন মাসের সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে কমিটি দিতে ব্যর্থ হন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

এ ব্যাপারে বিএনপির কেন্দ্র থেকে কোনো তদারকিও করা হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেন কমিটি দিতে পারেননি তার ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থা কী তা-ও তারেক রহমানকে জানানো হয়নি। এ নিয়ে সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের ওপর ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ড। হাফিজুল ইসলামকে আহ্বায়ক ও ফরহাদ হোসেন আজাদকে সদস্য সচিব করে ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট পঞ্চগড় জেলা বিএনপির ৪১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি দেয় বিএনপি। একই সঙ্গে তাদের তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর প্রায় দুই বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেননি পঞ্চগড় বিএনপির নেতারা।

এ প্রসঙ্গে জেলার সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর পর জেলার কিছু থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে বর্ধিত সভা ও কর্মিসভা করেছি। ঠিক এই সময়ে ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। এরপর মাঠপর্যায়ে সভা-সমাবেশ করে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়নি। তাছাড়া সরকারি দল ও পুলিশের নানা প্রতিকূলতাও আমরা মোকাবিলা করছি। এখন সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হলে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ একই অবস্থা ঝিনাইদহেও। ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট অ্যাডভোকেট এস এম মশিউর রহমানকে আহ্বায়ক ও অ্যাডভোকেট এম এ মজিদকে সদস্য সচিব করে ৫১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করে তাদের তিন মাসের সময় বেঁধে দেওয়া হয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ব্যর্থ হন। বিএনপির নতুন কমিটি দেওয়া ৩৭টি জেলার চিত্র একই।

খুঁড়িয়ে চলছে বিএনপির ‘ঢাউস’ নির্বাহী কমিটি : বিএনপির ৫০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় ‘ঢাউস’ কমিটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। গুটিকয় নেতা ছাড়া কারও কোনো কাজ নেই। আবার অনেকে নিজে থেকেই গা-ঢাকা দিয়ে চলছেন। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি নিয়মিত ভার্চুয়াল বৈঠক করলেও বাস্তবে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ১৯ সদস্যের এ কমিটির পাঁচটি পদ শূন্য। শারীরিক অসুস্থতাসহ নানা কারণে চারজন সব সময়ই থাকেন অনুপস্থিত। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি দিতে পারছে না স্থায়ী কমিটি।

তাছাড়া সাংগঠনিক তৎপরতায় তাদের তেমন কোনো ভূমিকাও নেই। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করেছিল বিএনপি। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় নির্বাহী কমিটি তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হবে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাহী কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত এ কমিটিই দায়িত্ব পালন করবে। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল শেষে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন। তারা হলেন- তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার ও সর্বশেষ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

এ ছাড়া রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জুনে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই হিসাবে এখন সদস্য সংখ্যা ১৪ জন। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রায় আড়াই বছর ধরে কারাবন্দী। এখন বিএনপির রাজনীতিতে তাঁর দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা নেই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই ভার্চুয়ালি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। মামলা জটিলতায় সালাহউদ্দিন আহমেদ রয়েছেন ভারতের শিলংয়ে। অসুস্থ আছেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া।

২০১৯ সালের মার্চে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কাউন্সিলের উদ্যোগ নেয়নি দলটি। মেয়াদোত্তীর্ণ ঢাকা মহানগরের দুই শাখা : ঢাকা মহানগর বিএনপির দুই শাখাও এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। মহানগর কমিটি ঢেলে সাজানোর কথা বিএনপিতে গত দুই বছর ধরেই চলছে। কিন্তু এখনো অগোছাল মহানগর বিএনপির দুই শাখা। বর্তমান মহানগর কমিটির শীর্ষ নেতাদের রেখে, নাকি তাদের বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্বে হবে-এ ব্যাপারে বারবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে আবারও নতুন করে কমিটি গঠনের আলোচনা শুরু হয়েছে।

জানা যায়, দেশের ১১টি মহানগর কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠনে তারেক রহমান সংশ্লিষ্টদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় আহ্বায়ক কমিটিও হয়েছে। ঢাকা মহানগর নিয়েও নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। কমিটির আলোচনায় বর্তমান কমিটির শীর্ষ নেতাদের বাইরেও সাবেক ছাত্রনেতাদের নামও উঠে আসছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব-উন নবী খান সোহেল বলেন, চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও করোনার কারণে আমরা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। এর মধ্যে আমরা অনেকগুলো ওয়ার্ড ও থানার কমিটি দিয়েছি। হাইকমান্ডের নির্দেশেই বাকিগুলো দেওয়া হয়নি। এখন যদি হাইকমান্ড মনে করে নতুন নেতৃত্বে চলবে ঢাকা মহানগর তাহলে আমরা সেই নির্দেশনা মেনে নেব।

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি এম এ কাইয়ুম বলেন, যদি হাইকমান্ড চায় নতুন কমিটিতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে ঢাকা সম্পর্কে যাদের জানাশোনা আছে তাদের নেতৃত্বেই যেন কমিটি হয়। তিনি বলেন, আমরা যারা ঢাকায় কাজ করছি, তাদের বিরুদ্ধে মামলা আর মামলা। তারপরও আমরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছি না। মহানগর বিএনপিকে দুই ভাগ করে সর্বশেষ কমিটি গঠন করা হয় ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল। দলের যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেলকে দক্ষিণের সভাপতি, কাজী আবুল বাশারকে সাধারণ সম্পাদক করে ৭০ সদস্যের আংশিক এবং উত্তরে এম এ কাইয়ুমকে সভাপতি, আহসান উল্লাহ হাসানকে (প্রয়াত) সাধারণ সম্পাদক করে ৬৬ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর আর দুই শাখায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here