ভাষা তুমি শক্তি দিও, মা যেমন শক্তি দিত : তসলিমা নাসরিন

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ আমাকে একটি ভাষা শিখিয়েছিল আমার মা, মায়ের নিজের ভাষা। ভাষাটি শিখতে শিখতে ডাঙর হয়েছি, শিখতে শিখতে মানুষ। ভাষাটি ছিল বলে কথা বলেছিলাম, খিদে-তেষ্টার কথা, ইচ্ছের কথা, ইচ্ছেগুলোর কথা। মুখ ফুটে বলেছিলাম, ‘আমার প্রাপ্যটুকু চাই’। ভাষাটি ছিল বলে গান গেয়েছিলাম, প্রতিবাদ লিখেছিলাম দেওয়ালে, ব্যক্তিগত কাগজে।

ব্যক্তিগত কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকেনি, আগুন হয়ে ছড়িয়েছিল সারা দেশে। ভাষাটি আমাকে দিন দিন কী আশ্চর্য রকম শক্তিময়ী করে তুলেছিল, আমি আর সেই সাত চড়ে রা না করা আমি ছিলাম না। রেল লাইনের গুমটি ঘরে ঘুরে বেড়ানো, বিকেল জুড়ে গোল্লাছুটের আমি ছিলাম না। বাড়ির ছাদে বসে একা একা রাতের তারা গোনার আমি ছিলাম না। আমি তখন হাজার মানুষের ভিড়ে হাঁটছি, আমি তখন বিভেদগুলো ভাঙছি, আমি তখন অগুন্তি বিষবৃক্ষ উপড়ে তুলছি। আমি তখন কেবল আমার নয়, সহস্র কোটির প্রাপ্যের কথা চিৎকার করে বলছি।

শুনে এমনই রাগ ওদের, গলা চেপে ধরেছিল আমার, ভাষা কেড়ে নেবে। হাত থেকে কলম কেড়ে নিল, ভাষা কেড়ে নেবে। বই পোড়ানোর উৎসব করল শহরে-নগরে, গঞ্জে-গ্রামে। ভাষা কেড়ে নেবে। আমাকে পোড়াল। পুড়ে আমি অঙ্গার হইনি, ইস্পাত হয়েছি। যে শক্তি আমাকে দিয়েছিল আমার মা, ওরা তা কেড়ে নেবে। কেউ কি নিতে পারে কারও ভেতর গভীর করে যদি কিছু থাকে, তা? কেউ কি পারে ওভাবে দু হাতে নখে দাঁতে ছিঁড়ে নিতে কিছু! ভালোবাসা পারে নিতে? ভাষা? ভাষা তো রক্তে থাকে, রক্ত থেকে কেউ কি ঠুকরে নিতে পারে ভাষার কণিকা? নির্বাসন দণ্ড হল আমার। আর কেউ নয়, কোনও স্বজন নয়, বন্ধু নয়, ভাষাটি রইল কেবল সঙ্গে।

একা একা আমরা দুজন। ভিনদেশে ভিনভাষীদের ভিড়ে আমরা দুজন, দুজনে নিভৃতে নিরালায় হৃদয়ে হৃদয়ে বাক্য বিনিময় করি। সারারাত না ঘুমিয়ে করি। ভিন-ভাষার শক্ত শক্ত মুষ্টিতে আঘাত পেতে আমার ভাষাটিকে দিই না, ভিন-ভাষার লোমশ পায়ের তলে পিষ্ট হতে আমার ভাষাটিকে দিই না, নিরীহ নির্জন ভাষাটিকে আগলে রাখি, দেখে দেখে রাখি। ভালোবেসে রাখি। চোখের জলে ভাষার গায়ের ধুলোকালি ধুয়ে রাখি। মায়ের মতো রাখি, বোনের মতো, ভাইয়ের মতো রাখি। ভাষাটি রইল নির্বাসনে। ভাষাটি রইল বরফে তুষারে, অন্ধকারে। ভাষাটি রইল আমার উচ্চারণে নয়, শ্রবণে নয়, হৃদয়ে। চতুর্দিকের হইচই থেকে এক কোণে একা, আমার মতোই।

ভাষাটি ক্রমে ক্রমে অসুস্থ হয় তীব্র শীতে, ভাষাটি জমে যেতে থাকে ঠাণ্ডা বরফে। বাঁচাতে থাকি তাকে বুকের উত্তাপ দিয়ে দিয়ে, শত্রু শিবিরে বসে শুশ্রূষা করি তার। সে আমার আত্মীয় তখন, বন্ধু তখন। সে আমার মা। কত কত বছর চলে গেল, কত কেউ চলে গেল, আপন কত কেউ, যেতে যেতে সীমানা পেরোনো, চোখের আড়াল। কোনও দিন আর ফিরে না আসা দূরত্বে এক এক করে মানুষগুলো চলে গেল। আমিই পড়ে আছি একা, সব হারিয়ে ফুরিয়ে নিঃস্ব। সঙ্গে কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু ভাষাটি। ভাষাটি আছে বলে চলে যাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে পারি। ভাষাটি আছে বলে চারদিক খাঁ খাঁ করার, একলা লাগার দু’-চারটে গদ্যপদ্য লিখতে পারি। খুব দুঃখ-কষ্টের দিনে ভাষার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে পারি। ভাষাটি আছে বলেই কেউ আছে।

কিন্তু, ভাষাটি তো যে করেই হোক লোকালয় চায়, দেশ চায়, উষ্ণতা চায়, উচ্চারণ চায়। ভাষাটির জন্য আমি সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে আজ এখানে। ভাষাটিকে বাঁচাতে। আমার ভাষাকে। ভাষা আজ সূর্যের মুখ দেখছে, আজ সে সূর্যমুখী। ভাষা আজ মাঠে ময়দানে বিকেলের রোদ্দুরে খেলছে, সে সুখী। ভাষার শরীর থেকে স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলা দূর হচ্ছে, সে সাঁতার কাটছে গঙ্গায়, বঙ্গোপসাগরে। আমি আর আমার ভাষা, দীর্ঘ বছরের বিদেশ বিভুঁই এর ক্লান্তিকর পরাধীনতা সরিয়ে এইখানে, দেশে, দেশের পশ্চিম প্রান্তে, নিশ্চিন্তে। আমি আর আমার ভাষা আজ ঘরে, নিজঘরে, নিরাপদ আশ্রয়ে। আমি যখন আমার ভাষাকে উচ্চারণ করি, আমার মাকে উচ্চারণ করি।

আমি যখন আমার ভাষাকে ভালোবাসি, আমার মাকে ভালোবাসি আমি। মা নেই, কেউ কেউ বলে মা নাকি কবে কোথায় আকাশের কোনও একটি তারা হয়ে গেছে। মা নেই, আমাকে মায়ের মতো দেখে দেখে রাখছে আমার মায়ের ভাষা, যে ভাষায় মা আমাকে ভালোবাসার কথা বলত, যে ভাষায় মা আমার জন্য কাঁদত, যে ভাষায় মা আমাকে তার কোলে ফিরে আসতে বলত। ভাষাটিকে আমি খুব নিবিড় করে আলিঙ্গন করি, মনে মনে বলি, মা তুমি। ভাষাটির শরীরে আমি আমার মায়ের সুগন্ধ পাই। মার বিষয়-আশয় কিছু ছিল না, সামান্য যা ছিল সব পচে ধসে গেছে, কেবল ভাষাটিই আছে, প্রতিদিন জীবন্ত, প্রাণময়।

মাকে আমি উচ্চারণ করি, মাকে আমি উচ্চারণ করছি। আমি উচ্চারণ করছি তোমাকে আমার ভাষা, তোমাকে উচ্চারণ করতে চাই, যতদিন শ্বাস নেব। তোমাকে ভালোবাসব, যতদিন বাঁচব। তোমার কাছেই বারবার ফিরে আসব। আমি তো চিরকালের নিরাশ্রয়, ভাষা তুমি আমাকে দেখে দেখে রেখো। মানুষের মার খেয়ে, ঘৃণা পেয়ে যখন নুয়ে পড়ব, ভাষা তুমি সাহস দিও, ভাষা তুমি শক্তি দিও, মা যেমন শক্তি দিত। প্রতিবাদ আমি লিখছি, পাথরগুলো সরাচ্ছি পথ থেকে, পথগুলো পথ হোক। আমাদের প্রাপ্য তো খল-পুরুষেরা লুটেপুটে খেল, আমরা নারীরা আজ বোবা, ভাষাহীন।

যতবারই কথা বলতে চাই, ততবারই মুখ চেপে ধরে ওরা। গলায় গরল ঢেলে দেয়। যতবারই কথা বলতে চাই, ততবারই ঠোঁটে সেলাই, জিভে কাঁটা। আমরা নারীরা আজ কী করে কাকে জানাব যে আমরা ভালো নেই! হাজার বছর ধরে পিঠে কালসিটে, চোখ নির্ঘুম, হাজার বছর ধরে আমরা ভাষাহীন। নারীর কণ্ঠে এবার ভাষা উঠে আসুক, স্ফুলিঙ্গ হোক সে, আগুনের মতো ছড়িয়ে যাক সবখানে, নারীরা পুড়ে পুড়ে ইস্পাত হোক। নারী শক্তিময়ী হোক।

ভাষা তুমি মা,

ভাষা তুমি আমি,

ভাষা তুমি বোন।

নারী আজ উচ্চারণ করছে ভাষা, নারী আজ উচ্চারণ করছে প্রতিবাদ। নারী আজ কণ্ঠে নিচ্ছে তীক্ষ্ণ তীব্র ভাষা, নারী আজ উচ্চারণ করছে নারীর জন্য নারীর ভালোবাসা। আমি এবং আমার ভাষা আজ খোলামেলা ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমাদের স্বাধীনতার পায়ে কেউ শেকল পরাতে এসো না, আমাদের মুক্তকণ্ঠকে কেউ চেপে ধরতে এসো না, আমাদের ভালোবাসার বুকে কেউ ছুরি বসাতে এসো না।

ক্ষমতা তুমি দূরে সরে থাকো,

ক্ষমতা তুমি পাথর ছুড়ো না,

ক্ষমতা তুমি পথরোধ করো না,

ক্ষমতা তুমি ভালোবাসতে শেখো,

ক্ষমতা পারোতো মানুষ হও,

ক্ষমতা তুমি মানুষ হও, মানবিক হও।

আমাকে থাকতে দাও আমার মতো, নির্বিবাদে, ভাষায় ভালোবাসায়। আমাকে থাকতে দাও আমার মায়ের কাছে, আমার মায়ের চোখের জল ধুয়ে দেবে আমার গায়ের ধুলোকালি। আমার মায়ের কোলটি থাকবে আমার জন্য। ওই কোলে সুখে কিংবা দুঃখে আমি ফিরব, মা তো চিরকালই ডাকতেন আমাকে, তার কোলে। {সংগ্রহ}

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here