পদ্মায় নৌকাডুবির ঘটনায় আরও ৫ জনের লাশ উদ্ধার

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ পদ্মা নদীতে শুক্রবার সন্ধ্যায় নৌকাডুবির ঘটনায় আরও ৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৬ জনে। শনিবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কনেসহ তিনজনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তখনও অভিযান চলছিল। বৌভাত শেষে বর-কনে ও স্বজনরা দুটি নৌকায় বাড়ি ফিরছিলেন। দুটি নৌকাই ডুবে গেলে ৪০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এ ঘটনায় বর ও কনে দুই পরিবারই শোকবিহ্বল। মৃত পাঁচজনই দুই পরিবারের। শনিবার সন্ধ্যায় চোখের পানি ও আহাজারিতে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়।

যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তারা হলেন- পবা উপজেলার ডাঙেরহাট এলাকার আবদুস সামাদের ছেলে শামীম হোসেন (৪৮), তার স্ত্রী মনিকা (৪০) ও মেয়ে রোসনি (৭)। শামীম কনে সুইটি খাতুন পূর্ণির চাচা। অন্যরা হলেন- রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ হড়গ্রাম ইউনিয়নের বসুয়া এলাকার আবদুল গাজীর ছেলে রতন আলী (৪০) ও তার মেয়ে মরিয়ম খাতুন (৬) এবং হড়গ্রাম ইউনিয়নের গোবিন্দপুরের আসলাম উদ্দিনের ছেলে এখলাক হোসেন (২৪)। রতন সম্পর্কে কনের দুলাভাই। এখলাক পূর্ণির খালাত ভাই। নিখোঁজ রয়েছেন কনে পূর্ণি, তার ফুপাতো বোনের মেয়ে রুবায়েত (৮) ও খালা আঁখি খাতুন।

এ ঘটনায় রাজশাহী জেলা প্রশাসন সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। দুই কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে বলা হয়েছে। কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলাম প্রাথমিকভাবে নৌকাডুবির তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, নৌকা দুটি ছিল ডিঙি। অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে বিপদ ঘটেছে। এছাড়া মাঝিরা ছিল অদক্ষ। আর এদের একজন ছিল কিশোর। পাশাপাশি ঝড়ো হাওয়ায় নৌকা দুটি পানিতে তলিয়ে যায়।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পাঁচ সদস্য ও বিজিবি সদস্যরা। নদীর পাড়ে বসে আছেন বর রুমন আলী (২৪)। থেকে থেকে তিনি কাঁদছিলেন। পরিবারের অন্য স্বজনদের উদ্ধারের আরজি জানাতে ও সহযোগিতা করতে দেখা গেছে।

স্বজনরা জানান, শ্যালোমেশিন চালিত নৌকা যখন মাঝপদ্মায় আকস্মিকভাবে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। মাত্র দেড় মিনিটের ঝড়ো হাওয়ায় অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে নৌকাটি ডুবে যায়। এ সময়ের বর্ণনা দিয়ে বর রুমন বলেন, আমি আর পূর্ণি পাশাপাশি বসেছিলাম। নৌকা ডুবে যাওয়ার পর সবাই বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় পূর্ণি আমাকে আঁকড়ে ধরে। আমাদের উদ্ধারে একটি বালুবাহী ট্রলার এগিয়ে আসে। ট্রলারটি থেকে একটি মোটা রশি ফেলা হয়। এ সময় সবাই রশিটি ধরে বাঁচার চেষ্টা করেন। আমিও রশিটি ধরে ফেলি। রশি ধরা নিয়ে হুড়োহুড়ির সময় পূর্ণি আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার আগপর্যন্ত দু’হাত দিয়ে সে আমাকে শক্ত করে ধরে ছিল।

পূর্ণির দুলাভাই আশরাফুল ইসলাম বলেন, পবা উপজেলার ডাঙেরহাট গ্রামের কৃষক শাহিন আলীর নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে পূর্ণির সঙ্গে মাস দেড়েক আগে বিয়ে হয় নদীর ওপারের চরখিদিরপুর গ্রামের ইনসার আলীর ছেলে রুমন আলীর। রুমন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়। নগরীর নিমতলায় তাদের বাড়ি আছে। সেখানে রুমন একাই থাকেন। আর তার পরিবারের সদস্যরা থাকেন চরে।

আশরাফুল জানান, বৃহস্পতিবার কনে বাড়িতে বিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। চর থেকে বর ও তার স্বজনরা এসে সেদিন কনেকে নিয়ে যান। শুক্রবার বরের বাড়িতে বৌভাতের আয়োজন করা হয়। সেদিন কনেপক্ষের স্বজনরা চরে গিয়ে বর-কনেকে নিয়ে এপারে ফিরছিলেন। এ সময় দুটি নৌকায় ৫০ জন যাত্রী ছিলেন। পদ্মায় দুটি নৌকার মাঝের দূরত্ব ছিল প্রায় এক কিলোমিটার।

একটি নৌকায় ছিলেন পূর্ণির মামাতো বোন তারিকা খাতুন (১৮)। তিনি জানান, তাদের নৌকায় বর-কনেসহ অন্তত ২৮ জন ছিলেন। নদীতে প্রচণ্ড বাতাস ছিল। আকাশে ছিল কালো মেঘ। হঠাৎ নৌকার নিচ থেকে পানি উঠতে শুরু করে। তখন পুরুষরা নৌকা থেকে নেমে নৌকা ধরেই সাঁতার কাটছিলেন। তারা ভেবেছিলেন নৌকা থেকে নেমে গেলে নৌকাটি ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু ৭-৮ জন পুরুষ নৌকার চারপাশ ধরে সাঁতার কাটার সময়ই নৌকাটি ডুবে যায়। এরই মধ্যে একটি বালু বহনকারী ট্রলার তাদের উদ্ধারে সেদিকে এগিয়ে যায়। যারা সাঁতার কাটছিলেন তাদের রশি দিয়ে টেনে ট্রলারে তোলা হয়।

পেছনের আরেকটি নৌকায় ছিলেন কনের মামা মাসুদ রানা (৩৫)। তিনি জানান, তাদের নৌকায় ২২-২৩ জন ছিলেন। মাঝপদ্মায় তাদের নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ নৌকার তলা ফেটে পানি উঠতে শুরু করে। তারাও ডুবতে শুরু করেন। ওই সময় সামান্য দূরে থাকা একটি ছোট নৌকা তাদের দিকে এগিয়ে যায়। সাঁতার কাটতে কাটতে তারা নৌকাটিতে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু দুইজন উঠতে পারেননি।

ট্রলারের সহযোগিতায় প্রাণে বাঁচেন কনের দাদা আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ট্রলার থেকে নামার পর স্থানীয় লোকজন কাপড় দেন। কম্বল দেন। সেগুলো জড়িয়ে আমরা বাড়ি আসি। তখনও জানতাম না যে পেছনের নৌকাটিও ডুবে গেছে। শনিবার সকালে ডাঙেরহাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পুরো গ্রামেই শোকের ছায়া। পূর্ণির বাড়িতে মানুষের ঢল। নদীতে কারও লাশ পাওয়া গেছে কিনা, তা ফোন করে একটু পরপর জানার চেষ্টা করছেন তারা। কিছুক্ষণ পরপরই উঠছে কান্নার রোল। আর চলছে শোকের মাতম। কিছুটা দূরেই পূর্ণির দাদাবাড়ি। এ বাড়ির তিন সদস্য পূর্ণির চাচা শামিম, স্ত্রী মনিকা ও তার মেয়ে রোশনিরও লাশ পাওয়া গেছে। সে বাড়ির সামনেও অনেক মানুষের ভিড়। ভেতরে কান্নাকাটি করছেন নারীরা।

নৌকা দুটি ছিল ডিঙি : শনিবার দিনভর ঘটনাস্থলে ছিলেন জেলার পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, কনেপক্ষের স্বজনদের বহনকারী নৌকা দুটি ছিল ডিঙি নৌকা। এসব নৌকা হালকা। এগুলো পদ্মায় মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত যাত্রী নেয়ার কারণেই নৌকা দুটি ডুবে যায়।

যাত্রী বহনকারী একটি নৌকার মাঝি ছিল কিশোর জহিরুল ইসলাম রাতুল। তার বাবার নাম মেরাজুল ইসলাম। ঘটনাস্থল শ্রীরামপুর পদ্মা নদীরপাড় লাকায় তার বাড়ি। রাতুলের কাছে তার বয়স জানতে চাইলে ১৮ বলে দাবি করে। কিন্তু সেখানে উপস্থিত লোকজন তার বয়স বড় জোর ১৪ বছর হবে বলে মত দেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স রাজশাহী সদর স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আবদুর রউফ বলেন, ডুবে যাওয়া নৌকার মধ্যে আমরা একটি উদ্ধার করেছি। আমাদের উদ্ধার অভিযান রাতেও চলবে।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক হামিদুল হক জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা এখনও নিখোঁজ রয়েছেন তাদের উদ্ধারে তিনটি টিম কাজ করছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক উদ্ধার তৎপরতা মনিটরিং করা হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here