প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ পীর আবদুল মান্নান: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের অন্তত অর্ধশতাধিক আসনে নির্বাচন জমিয়ে তুলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এসব আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী যেখানে শক্তিশালী কিংবা জনপ্রিয়তায় এগিয়ে সেসব আসনে চাপে দলীয় প্রার্থীরা। এরই মধ্যে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংঘাত হয়েছে ৩০টির বেশি আসনে। নির্বাচনী সংঘাতে মৃত্যুও হয়েছে তিনজনের।
সারাদেশের অধিকাংশ আসনে দলের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা এগিয়ে থাকলেও অর্ধশতাধিক স্বতন্ত্রের সঙ্গে বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই জিততে হবে। নির্বাচন নিয়ন্ত্রণমুক্ত হলে ৩০টির বেশি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রচার-প্রচারণা ও মাঠের নেতাকর্মীরা এমনটাই দাবি করছেন। তবে সংশ্লিষ্ট আসনগুলোর দলীয় প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের দাবি, শেষ পর্যন্ত এ পরিবেশ থাকবে না। সবাই দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে এক হয়ে যাবে।আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে স্বতন্ত্র বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলেও কোনো বিরূপ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে দুটিতে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিশালী। দল মনোনীত প্রার্থী বেশ বেকায়দায়। এর মধ্যে ঢাকা-১৮ আসনে মহাজোট মনোনীত প্রার্থী শেরিফা কাদেরকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী খসরু চৌধুরী। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক। পুরো এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার পক্ষে কাজ করছেন। প্রচার-প্রচারণায়ও এগিয়ে তিনি।
লাঙ্গল প্রতীকের শেরিফা কাদের বরং কোণঠাসা। ঢাকা-১৯ আসনে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের বিপরীতে লড়ছেন সাবেক এমপি তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ। রানা প্লাজা ধসে কপাল খোলা এনামকে এবার চ্যালেঞ্জে ফেলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ। সাভারের স্থানীয় মুরাদ এরই মধ্যে প্রচারণায় সাড়া ফেলেছেন। ঢাকা-৪, ঢাকা-৫ সহ আরও দু-একটা আসনে শক্ত অবস্থানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ফরিদপুর-৩ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন একই কমিটির উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের আজাদ (এ কে আজাদ)।
প্রচারণার প্রথম দিকে বেশ প্রভাব বিস্তার করলেও শামীম হক চুপসে গেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। প্রশাসনিক চাপ ও জনগণের মনোভাব তার কাছে পৌঁছেছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। আসনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর অবস্থান বরাবরই ভালো। এ কে আজাদ বলেন আমাদের কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে প্রায় এক লাখ লোক আমার ভোটার।তারা মাঠে নেমে গেছে। এজন্য ওরকম তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমিআশা করি না। বিপুল ভোটের ব্যবধানে আমি জয়ী হবো।
ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন)। গত দুই নির্বাচনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে নৌকা ডুবিয়েছেন তিনি। এবারও নৌকা তার কাছে ডুববে, এমনটাই জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। মাদারীপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আব্দুস সোবহান গোলাপকে চ্যালেঞ্জ করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাহমিনা বেগম।
এলাকায় এরই মধ্যে তার পক্ষে রব উঠেছে। শ্রমিক-দিনমজুররা ১০০-২০০ টাকা করে চাঁদা তুলে নির্বাচনী ব্যয় মেটাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য, নৌকার প্রার্থী এলাকায় আসেন না। তাকে পাওয়া যায় না। আমরা স্বতন্ত্রকে চাই।আওয়ামী লীগের রাজধানীখ্যাত গোপালগঞ্জ-১ আসনেও স্বতন্ত্রের দাপট। কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছেন নৌকার প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খানের বিরুদ্ধে লড়ছেন মুকসুদপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কাবির মিয়া। আরও তিনজন প্রার্থী থাকলেও ভোটের মাঠে দেখা মিলছে নৌকা-ঈগলের।
পাঁচবারের এমপি ফারুক খান এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে স্বাগত জানালেও বিরোধীরা বলছেন, নৌকার মাঝিকে আমরা কাছে পাই না। তাই পরিবর্তন চাই।কুমিল্লা জেলার ১১ আসনের মধ্যে চারটিতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। স্বতন্ত্রের দাপটে বেশিরভাগ জায়গায় তটস্থ নৌকার প্রার্থী। কুমিল্লা-২ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য সেলিমা আহমাদ মেরির সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ। প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। যার কারণে বেশ দুশ্চিন্তা নৌকার প্রার্থী মেরি শিবিরে।
কুমিল্লা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। তার সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দেবীদ্বার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। কুমিল্লা-৭ আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান এমপি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রয়াত এমপি অধ্যাপক আলী আশরাফের ছেলে ও চান্দিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ টিটু। সাংগঠনিকভাবে টিটুর অবস্থান বেশ শক্তিশালী।
কুমিল্লা-১১ আসনে মুজিবুল হককে ভালো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন সাবেক পৌর মেয়র ও ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মিজানুর রহমান। গাজীপুর জেলার পাঁচ আসনের চারটিতেই শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী আছে। এর মধ্যে বেশি চাপে আছেন গাজীপুর-৫ ও ৩ আসনের নৌকার প্রার্থী। গাজীপুর-৫ এ মেহের আফরোজ চুমকির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারুজ্জামান। গাজীপুর-৩ আসনে রুমানা আলীকে চ্যালেঞ্জ করছেন সাবেক এমপি ইকবাল হোসেন সবুজ।
আরও যত আসনে স্বতন্ত্রের দাপট : পিরোজপুর তিনটি, পটুয়াখালীর দুটি আসন এবং বরিশালেও রয়েছে এই স্বতন্ত্রের ফাঁদ। চাঁদপুর সদরে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামছুল হক ভুইয়া। চট্টগ্রাম-১ আসনে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে শক্ত স্বতন্ত্র সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও ডাকসাইটে আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন। হবিগঞ্জের মাধবপুর চুনারুঘাটে বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীকে চাপে রেখেছেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন।
নেত্রকোনা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনের ঘাড়ে শ্বাস ফেলছেন সাবেক এমপির ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। ময়মনসিংহ-৪ আসনে প্রয়াত ধর্মমন্ত্রীর ছেলে মহিতুর রহমান শান্তর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন সিটি মেয়রের বড় ভাই আমিনুল হক (শামীম)। রাজশাহী-১ আসনে আওয়ামী লীগের তিনবারের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে ট্রাক প্রতীক নিয়ে লড়ছেন ঢালিউড নায়িকা মাহিয়া মাহি। প্রচার-প্রচারণায় বেশি এগিয়ে তিনি। এছাড়াও ময়মনসিংহ-১০, মেহেরপুর-১ ও বগুড়া-১ আসনে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।