একান্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগকারী তাঈদ উদ্দিন খান

0
একান্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগকারী তাঈদ উদ্দিন খান

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ প্রেস নিউজ ডেস্কঃ ১৯৯৬ এর ৩১ আগস্ট। রাজশাহী থেকে ঢাকায় ছুটে এলেন দুই যুবক। তাঁরা ধানমণ্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করতে এসেছেন। এক যুবকের নাম মোঃ তাঈদ উদ্দিন খান, অন্যজন মোঃ মোহসিনুল হক। ধানমণ্ডি থানা এজাহারটি গ্রহণ করলেও তেমন অগ্রগতি চোখে পড়েনি।

সেই সময়ের সকল পত্রিকা এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে এই ঘটনা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়। এমনকি কিছুদিন আগেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আবদুল মান্নান ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই ঘটনার উল্লেখ করেন। এ ছাড়া অধ্যাপক ড. নীলিমা ইব্রাহিম এক বক্তৃতায় এই ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজের ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও বিচার’ গ্রন্থেও ঐ এজাহারের কথা উল্লেখ আছে।

এই এজাহার পত্রে মন্তব্য করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৫৬ নম্বর সাক্ষী ও এজাহার গ্রহীতা সেই সময়কার ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ শফিক উল্লাহ এজাহার পত্রে লিখেছিলেন, ‘অত্র গণহত্যার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন রহিয়াছে বিধায় আপাততভাবে নিয়মিত মামলা রুজ্জু না করিয়া উহা বিবেচনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহিত আলোচনাক্রমে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।

সেই ঘটনার ২৭ বছর আজ।এই প্রথমবারের মতো অভিযোগকারীদের অন্যতম মোঃ তাঈদ উদ্দিন খান কথা বলেছেন দেশের কোন মিডিয়ার সাথে। তিনি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের একজন সফল আইনজীবীপ্রশ্নঃ ১৯৯৬ সালে আপনারা যখন এমন একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিলেন এর মানসিক প্রস্তুতি কবে থেকে নিচ্ছিলেন? কখন মাথায় এল যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের সম্মুখিন করা উচিত?

তাঈদ উদ্দিন খানঃ ১৯৯৬ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান নেতা, স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২১তম শাহাদাত বার্ষিকী ভাবগাম্ভীর্য্যরে সাথে সারাদেশে পালিত হয়। এই দিনটি আমাদেরকে ব্যথিত করে। তখন থেকেই এই নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচার হওয়া একান্ত দরকার – এই অনুভূতি আমাদের মনে তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে।

কিন্তু ছোটবেলা থেকেই Indemnity Ordnance প্যান্ডোরার বাক্স এই হত্যাকান্ডের বিচারের প্রতিবন্ধকতার প্রচার শুনে আসছি। ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের উপর ৩২ নং বাড়ীকে ঘিরে ম. হামিদ প্রযোজি ’ ‘সেই অন্ধকার’’ নামক একটি ডকুমেন্টারী বিটিভিতে প্রচারিত হয়। এই ডকুমেন্টারীতে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের মর্মস্পর্ষী বর্ণনা, ঘটনাস্থল, বিভিন্ন আলামত এবং প্রত্যক্ষ্যদর্শীসহ সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এই ডকুমেন্টারী আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ চলচ্চিত্রটিও এ মাসেই প্রচারিত হয়েছিল বিটিভিতে। সেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনাবলী চিত্রিত হয়েছিল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। আরো চিত্রিত হয়েছিল বর্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা আর গণহত্যার বীভৎসতা। ‘সেই অন্ধকার’’ নামক ডকুমেন্টারীতে প্রচারিত বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মর্মস্পর্ষী বর্ণনা এবং ‘ধীরে বহে মেঘনা’ চলচ্চিত্রটিতে গণহত্যার দৃশ্য দেখেই বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও স্বজনদের হত্যাকান্ড মানবতাবিরোধী ও গণহত্যাজনিত অপরাধ বলেই মনে হয়। এরপর গণহত্যা বিষয়ে দেশের প্রচলিত আইন কানুন ঘাঁটতে থাকি।

আইনের ছাত্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানও দেখি। আমরা দেখতে পাই আমাদের সংবিধানে গণহত্যাজনিত অপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সুব্যবস্থা আছে। বঙ্গবন্ধুই সংবিধানে এ সংক্রান্ত বিধান রেখে গেছেন তার অসীম দূরদর্শিতা বলে। আমাদের সংবিধান পাঠ করে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারি মানবতাবিরোধী এই নারকীয় গণহত্যাজনিত অপরাধ সংঘটনকারী সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী অফিসারের বিচার সংবিধানের আলোকে করা সম্ভব। Indemnity Ordnance এক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। এরপরই আমরা অভিযোগ দায়েরের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি।

প্রশ্নঃ ৩১ আগস্ট ১৯৯৬ এর আগে পরে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী কোন মহল বা ব্যক্তির সাথে আপনারা যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন?
তাঈদ উদ্দিন খানঃ না। তবে আমরা আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর আফম মহসিন স্যারের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করি। তিনি বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখেন এবং আমাদেরকে সৎ সাহস যোগান। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। এছাড়া স্থানীয় কয়েকজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সঙ্গেও মতবিনিময় করি। তারাও আমাদের সঙ্গে এই বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
প্রশ্নঃ ধানমন্ডি থানায় যে এজাহার বা অভিযোগ দায়ের করেছিলেন সেটির ভাষা এক কথায় অসাধারণ। অনেকের সাথে অভিযোগ পত্রটি নিয়ে আমি কথা বলেছি, প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন যে এটি একটি অসামান্য অভিযোগ পত্র। এটি লিখতে আপনারা কারো সাহায্য নিয়েছিলেন?
তাঈদ উদ্দিন খানঃ কোন ব্যক্তির সাহায্য নেই নি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ফৌজদারী কার্যবিধি এবং দন্ডবিধি পাঠ করেছি। এছাড়া ৭৫ এর এই নারকীয় হত্যাকান্ডের উপর লিখিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন, ডকুমেন্টারী, বিভিন্ন প্রকাশনা এবং বুদ্ধিজীবীদের লেখা ও আলোচনা সংগ্রহ করে পাঠ করেছি। এগুলো থেকে অর্জিত জ্ঞান ও ধারণার ভিত্তিতে আমরা অভিযোগ পত্রটি লিখি।
প্রশ্নঃ বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারেই বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করা সম্ভব – এটি সর্বপ্রথম কখন জানতে পারলেন?
তাঈদ উদ্দিন খানঃ ১৯৯৬ এর আগস্ট মাসেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান পাঠ করে দেখতে পাই ৪৭(৩), ৪৭ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই গণহত্যাজনিত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার পরিস্কারভাবে করা সম্ভব।
প্রশ্নঃ অভিযোগপত্র নিয়ে যখন ধানমন্ডি থানায় গেলেন – সে সময়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন প্লিজ।
তাঈদ উদ্দিন খানঃ ৩১ আগস্ট ১৯৯৬, আনুমানিক সময় বিকাল ৫ ঘটিকায় এই গণহত্যাজনিত ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিষয়ে বিচারের জন্য অভিযোগ দায়ের করতে ধানমন্ডি থানায় যাই। ওই সময় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর শফিক উল্লাহ থানায় উপস্থিত ছিলেন না। আমরা ডিউটি অফিসারের কাছে ১৩ পৃষ্ঠার হাতে লিখিত অভিযোগ পত্র দাখিল করি। বিষয়টি তিনি দেখে তাৎক্ষণিকভাবে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
অল্প সময়ের মধ্যেই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থানায় আসেন এবং আমাদেরকে তার কক্ষে নিয়ে অভিযোগ পত্রটি পাঠ করেন। আমরা তাকে অভিযোগ পত্রটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার অনুরোধ জানাই। পাশাপাশি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান থেকে এ সংক্রান্ত কিছু অনুচ্ছেদ পাঠ করে শোনাই। এরপর তিনি ডিএমপি কমিশনারকে ফোন করেন এবং জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের উপর অভিযোগ নিয়ে এসেছেন, তারা আমাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান দেখাচ্ছেন।
এখন আমি কি করবো স্যার?’ তখন ডিএমপি কমিশনার জানান, ‘তুমি ওদের ফিরিয়ে দিও না, তুমি অভিযোগটি গ্রহণ করো। আমি উপরে যোগাযোগ করছি।’ এরপর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অভিযোগটি গ্রহণ করে আমাদের কপিতে লিখেন: ‘মূলকপি বুঝিয়া পাইলাম। অত্র গণহত্যার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন রহিয়াছে বিধায় আপাততভাবে নিয়মিত মামলার রুজু না করিয়া উহা বিবেচনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহিত আলোচনাক্রমে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।
প্রশ্নঃ আপনারা অভিযোগ পত্রে নিজেদেরক বঙ্গবন্ধুর সন্তান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে আপনার নিজস্ব কোন পর্যবেক্ষণ আছে?
তাঈদ উদ্দিন খানঃ চতুর্থ সংবিধান সংশোধন আইনের ৩৫বি ধারা বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা। সেহেতু আমরা সবাই তাঁরই সন্তান। এ কারণেই অভিযোগ পত্রে আমরা নিজেদেরকে বঙ্গবন্ধুর সন্তান হিসেবে উল্লেখ করেছিলাম। বাঙালী জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর অবদান অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান নেতা, স্বাধীনতার রূপকার।
প্রশ্নঃ ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট আপনারা বঙ্গুবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে ধানমন্ডি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। সেই অভিযোগ দায়েরের ২৭ বছর আজ। কেমন অনুভূতি!
তাঈদ উদ্দিন খানঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আমাদের উপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনার্থে বঙ্গুবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে ধানমন্ডি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলাম। এই অনুভূতি অন্য ধরনের। আমরা যে কাজ করেছিলাম এ দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই এই দায়িত্ব পালন করা উচিত ছিল।
এই জঘন্য হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে। বিচারে ১২ জনের মৃত্যুদন্ডের রায় হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এখন পলাতক সকল আসামীকে দেশে ফিরিয়ে এই রায় শতভাগ কার্যকর করতে পারলেই বাংলাদেশ অভিশাপ মুক্ত হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here