সারা বিশ্বে মহামন্দার ধ্বনি শোনা যায়, প্রস্তুত কি বাংলাদেশ?

0
সারা বিশ্বে মহামন্দার ধ্বনি শোনা যায়, প্রস্তুত কি বাংলাদেশ?

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিনই ব্যাপক হারে বাড়ছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যুও। মহামারি করোনার বিস্তার ঠেকাতে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দেশজুড়ে অঘোষিত লকডাউনে জনজীবনে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে।

বৈশ্বিক বাস্তবতা পর্যালোচনায় করোনা মোকাবিলায় কোনও ঝুঁকি না নেয়ার কথা বলছে সরকার। যদিও এর মধ্যে ১০ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানা সাপেক্ষে রমজান ও ঈদুল ফিরতকে সামনে রেখে বিভিন্ন দোকানপাট ও শপিং মল খুলে দেয়ার ঘোষণা এসেছে। টানা ষষ্ঠ দফায় সাধারণ ছুটি বাড়ানো হয়েছে ১৬ মে পর্যন্ত। কিন্তু দীর্ঘ এই ছুটি আর লকডাউনে দেশের অর্থনীতিতে মন্দার অভিঘাত আসন্ন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে যেতে পারে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। ইতোমধ্যে দেশের সকল ব্যবসা-বাণিজ্য বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে।

দেশে দেশে অভ্যন্তরীণ যোগযোগসহ বিশ্বব্যাপী উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ, হোটেল পর্যটকশূন্য, বিপণিবিতানে ক্রেতা নেই, কারখানাগুলোর চাকা ঘুরছে না, আমদানি-রফতানিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের চাহিদায় ধস নেমেছে। বিভিন্ন দেশ এরইমধ্যে ক্রয়াদেশ বাতিল করতে শুরু করেছে। গত এপ্রিল থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্যপণ্য ও ওষুধ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কবে স্বাভাবিক হবে দেশ, সেটাও কেউ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছেন না।

দেশের এই অচলাবস্থায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন বেসরকারি খাতের শ্রমিক, চাকুরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার, রিকশা-ভ্যান-অটোরিকশাচালক ও দিনমুজুর শ্রেণির মানুষ। আয় না থাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের কর্মীদের নিয়মিত বেতন দিতে পারছে না, বেতনে বিলম্ব হচ্ছে। অনেকে বিনা বেতনে বাধ্যতামূলক ছুটির মুখে পড়েছেন। অনেকেই চাকুরি হারিয়ে হাহুতাশ করছেন। আবার স্বল্প পুঁজির কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

একইসময়ে আন্তর্জাতিক জনশক্তি রফতানি বাজারেও মহামন্দা দেখা দিয়েছে। যার বড় প্রভাব এসে পড়েছে বাংলাদেশে। জনশক্তি নিয়ে কর্মরত বাংলাদেশি সংস্থা ওআরবি জানিয়েছে, করোনা মহামারির কারণে গত কয়েক মাসে ৪ লাখের মতো প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বৈশ্বিক পর্যায়ে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশে রেমিটেন্স বা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ প্রায় ২২ শতাংশ কমে যাবে।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছে প্রবাসীরা। বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি বছর তা কমে নেমে আসছে ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই কমবে রেমিটেন্স। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ রেমিটেন্স কমতে শুরু করেছে। বছরের প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ গত মার্চ মাস পর্যন্ত গত বছরের তুলনায় রেমিটেন্স কমেছে ১২ শতাংশ। যা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গেল বছর মার্চ পর্যন্ত প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ ছিল ১৪৬ কোটি ডলার, যা এ বছর একই সময়ে নেমে এসেছে ১২৮ ডলারে। এপ্রিলে তা আরও নিম্নমুখি হবে।

জাতিসংঘের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ৩০ বছরে এ প্রথম বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য বাড়বে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। কিংস কলেজ লন্ডন এবং অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (এএনইউ) বিশেষজ্ঞরা এ প্রতিবেদনটি লিখেছেন। যেখানে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০ থেকে ৬০ কোটি বাড়তে পারে। ফলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যটি পূরণ করতে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

সবশেষ ২০০৭ ও ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল। তাতে বহু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। তবে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা হয়েছিল ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত। যাকে মহামন্দা আখ্যা দেয়া হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ নতুন মন্দার আগুনে ঘি ঢালছিল। সেটি শেষ পর্যন্ত শীতল হলেরও এবার করোনার বিশ্বব্যাপী যে খাণ্ডবদাহন শুরু হয়েছে তার ভস্ম কতদূর ছড়াবে হয়তো সময়ই বলে দেবে।

কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, এখন থেকেই যদি উচিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়, যদি দল-মত নির্বিশেষে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণের অঙ্গীকারে আবদ্ধ করা না যায়, যদি দেশের সম্পদকে যথাযথভাবে সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত করা না হয়- তবে ভয়াবহ মাশুল গুণতে হতে পারে বাংলাদেশকেও।

মন্দা (রিসেশন) যখন দীর্ঘায়িত হয় তখন সেটা মহামন্দায় (ডিপ্রেশন) পরিণত হয়। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, মন্দা একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর ঘুরে ফিরে আসে। বাংলাদেশেও মন্দা যেন মহামন্দায় পরিণত না হতে পারে তার জন্য এখনই প্রবল প্রতিরোধ গড়তে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here