সঞ্চয়ের শেষ আশ্রয়টিও হারাচ্ছেন নিম্ন মধ্যবিত্তরা।

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ কমে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের জায়গা। শহরাঞ্চলের মানুষ সাধারণত ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র এবং শেয়ারবাজারে তাদের সঞ্চয়ের অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের সঞ্চয় বিনিয়োগের একমাত্র জায়গা কেবলমাত্র ডাকঘর। সেই ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক বিধি অনুযায়ী পরিচালিত সঞ্চয়স্কিম বা কর্মসূচির সুদের হার কমিয়ে প্রায় অর্ধেক করেছে সরকার, যা গত বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। ফলে এ মানুষগুলোর অর্থ বিনিয়োগের জায়গা সীমিত হয়ে আসছে।

সরকারের এ সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে এই নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের মধ্যে। হঠাৎ বড় ধরনের মুনাফা কমানোতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা। কেননা এ আয়ের ওপর নির্ভর করেই চলে তাদের জীবন-যাপন। তারা বলছেন, জীবন ধারণের শেষ আশ্রয়স্থলও নড়বড়ে করে দিচ্ছে সরকার। তারা এখন কোথায় যাবেন? বাচ্চার স্কুলের বেতন কীভাবে দেবেন? ওষুধ খরচ কই পাবেন? মাসিক চলার খরচ জোগাবেন কোথা থেকে? মুনাফার জন্য শেষ ভরসার জায়গাটাই থাকল না তাদের।

পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ডাকঘর সঞ্চয়ের নতুন এ সুদহারের কারণে এখন কোনো আমানতকারী ডাকঘর সঞ্চয়ের আমানত রাখলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এখন কোনো বিনিয়োগকারী এক বছর অন্তর সুদে আমানত রাখলে তিনি ৫ শতাংশ সুদ পাবেন।

অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির কারণে তার জমা টাকা যে মান হারাচ্ছে সুদ পাওয়া যাবে তার চেয়েও কম হারে। সংশ্লিষ্টদের মতে, মূলত গ্রামা লের বা ডাকঘরের আশপাশে যাদের বসবাস সেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষই ডাকঘরের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করেন। এর মধ্যে যারা অবসর নিয়েছেন বা গৃহিণী তারাই বেশি। সংখ্যার হিসাবে তারা বেশি হলেও পরিমাণের দিক থেকে খুবই কম। মাত্র ২ শতাংশ। এই শ্রেণির মানুষের আয়ে হাত দিয়ে সরকার মোটেও ঠিক কাজ করেনি। কেন এমনটা করা হয়েছে সে বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করেন তারা।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতির তুলনায় ডাকঘর সঞ্চয়েরস্কিমের সুদের হার কম নির্ধারণ হওয়ায় এতে আমানতকারীরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে সামগ্রিক সঞ্চয় ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সরকার কেন এটা করল তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। এতে শুধু যে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা নয়, সমাজে আয়-বৈষম্যও তৈরি হবে। ফলে সরকার কোন যুক্তিতে এটা করল, তা স্পষ্ট করতে হবে। এবং এর ফলে কতগুলো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলো সেটাও প্রকাশ করতে হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতের ঋণে আগামী ১ এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এজন্য চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে ব্যাংকগুলো আমানতে সুদহার ৬ শতাংশে সঞ্চয়পএ এবং ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমে যদি সুদহার ১১ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে আমানতকারীরা ব্যাংকে আমানত না রেখে স য়পত্রে বা সঞ্চয়স্কিমে বিনিয়োগ করবে। এতে ব্যাংকিং খাতে আমানতে সঙ্কট দেখা দেবে। তাই আমানতকারীদের ব্যাংকমুখী করতে অর্থবছরের শুরুতেই স য়পত্রে উৎসেকর বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। আর এখন ডাকঘর সঞ্চয়স্কিমের সুদহারও কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এদিকে গতকাল সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি ডাকঘরে গিয়ে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্র নাকি ডাকঘর স য়স্কিমের সুদহার কমানো হয়েছে এ নিয়ে এখনো বিভ্রান্তিতে রয়েছে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী। সেই সঙ্গে হতাশা প্রকাশ করেছেন ডাক বিভাগের কর্মকর্তারা। তা

রা জানান, ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে এমনিতেই ডাক বিভাগের কার্যক্রম ছোট হয়ে আসছে। ডাকঘর সঞ্চয়সহ বেশকিছু স্কিমের মাধ্যমে সংস্থাগুলো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ কার্যক্রমেও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এক ডাকঘরে টাকা জমা রেখে অন্য ডাকঘর থেকে সে টাকা উত্তোলন করা যায় না। ফলে ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমে মানুষের আস্থাও কম। এখন সুদের হারে লাগাম টেনে ধরা হলে মানুষ আর স য় রাখতেও ডাকঘরে আসবে না। ফলে নিম্ন আয়ের ক্ষুদ্র গ্রাহকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তেমনি ডাক বিভাগের কার্যক্রমও সংকুচিত হয়ে আসবে।

দুপুর ১২টার দিকে মনোয়ারা বেগম নামের একজন বিনিয়োগকারী শান্তিনগর ডাকঘরে খোঁজ নিতে আসেন সুদহার কমানো হয়েছে কোনোটার। ১০ মিনিটের মধ্যে আরো ৫-৬ জন একই বিষয়ে জানতে আসেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শান্তিনগর ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার গিয়াসউদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদের কারণেই তাদের মধ্যে এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটা ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে। তবে কেন এটা করা হয়েছে সে বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। এতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই কয়েকদিনে নতুন কোনো বিনিয়োগকারী আসেননি। এতে ক্ষুদ্র স য়কারীরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গত রোববার পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ১৩ ফেব্র্রুয়ারি একটি পরিপত্র জারি করে। এটির মাধ্যমে ডাকঘরে যে সঞ্চয় ব্যাংক রয়েছে সেই ব্যাংকের সুদের হার সরকারি ব্যাংকের সুদ হারের সমপর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু সরকারের যে সঞ্চয়পত্র সেটির সুদের হার কমানো হয়নি, এটি যা ছিল তাই আছে।

এতে আরো বলা হয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের পরিপত্রটি জারির পর বিভিন্ন গণমাধ্যম বা পত্রপত্রিকায় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বিধায় বিষয়টি স্পষ্টিকরণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ডাকঘর থেকে যেমন সঞ্চয়পত্র কেনা যায়, তেমনি ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের আওতায়ও টাকা রাখা যায়। ডাকঘরে চারভাবে টাকা রাখা যায়। ডাকঘর থেকে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরে সঞ্চয়পত্র কেনা যায়, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাব ও সাধারণ হিসাব খোলা যায়। আবার ডাক জীবন বীমাও করা যায়।

এবার সুদের হার কমেছে ডাকঘরের সঞ্চয় স্কিমের মেয়াদি হিসাব ও সাধারণ হিসাবে। সাধারণ হিসাবের ক্ষেত্রে সুদের হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এ-সংক্রান্ত যে নির্দেশনা জারি করেছে তাতে বলা হয়েছে, তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার হবে ৬ শতাংশ, যা এত দিন ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল। মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙানোর ক্ষেত্রে এক বছরের জন্য সুদ মিলবে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। দুই বছরের ক্ষেত্রে তা সাড়ে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ।

এর আগে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে চলতি অর্থবছর থেকেই সঞ্চয়পত্রে উৎসেকর বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেয়ার সময় মুনাফার ১০ শতাংশ উৎসে কর হিসেবে কর্তন করা হয়। আগে এ হার ছিল ৫ শতাংশ। সরকারের সিদ্ধান্তে নতুন হার চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। এর প্রভাবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ তলানিতে নেমেছে।

এই খাতে কমেছে ঋণপ্রবাহ। বেড়েছে অবসরভোগী আর নি¤œ মধ্যবিত্তের উদ্বেগ। অর্থবছরের অর্ধেক সময় পার হওয়ার পর সেই উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়ে সঞ্চয়পত্রে প্রচলিত কর রেয়াত সুবিধা যৌক্তিকীকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত নগদ এবং ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির ৪৪তম সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা ঝুঁকি ও ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে স য়পত্রে বিনিয়োগের বিপরীতে এনবিআরের প্রদেয় আয়কর রেয়াতের বিষয়টি পর্যালোচনার মাধ্যমে যৌক্তিকীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিয়ে সভায় আলোচনার এক পর্যায়ে উল্লেখ করা হয় যে, এই খাতে বিনিয়োগকারীরা একদিকে যেমন উচ্চ হারে সুদ পাচ্ছেন, অন্যদিকে তারা আয়কর রেয়াত পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা দ্বৈত সুবিধা পান। এ ধরনের দ্বৈত সুবিধাপ্রাপ্তি আয়কর রেয়াত যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে কমানো যেতে পারে সভায় অনেকে মতপ্রকাশ করেন। এখন কর রেয়াত ‘যৌক্তিকীকরণ’-এর বিষয়টি সুনির্দিষ্ট কী হবে সেটি এনবিআর চূড়ান্ত করবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

এক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রে বড় বিনিয়োগে কর রেয়াত সুবিধা প্রত্যাহার হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ সিদ্ধান্তটিকে ত্রুটিপূর্ণ ও ভুল বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, স য়পত্র বিনিয়োগ চালু হয়েছে বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা দেয়ার জন্য। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, অবসরভোগী এবং নারী বিনিয়োগকারীদের রাষ্ট্রের পক্ষে কিছু সুবিধা দিতেই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কিছুটা বেশি রাখা হয়েছে। এটা এক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি।

এখন প্রথমে এটিতে উৎসেকর দ্বিগুণ করা হলো। এখন আবার কর যৌক্তিকীকরণের নামে অবসরভোগী আর নিম্ন আয়ের মানুষ যারা সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল তাদের নতুনভাবে করের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। এতে মানুষের মধ্যে একদিকে যেমন আয়বৈষম্য বাড়বে অন্যদিকে জাতীয় স য়ের পরিমাণও কমবে এবং বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বাড়িয়ে মানুষকে বিনিয়োগমুখী করা। সেটি না করে এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলে সঞ্চয় কমবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here