প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ আজ আমি এমন একটি জায়গায় যাচ্ছি যেখানে আমার অনেক বন্ধুরাই গিয়েছেন, প্রান ভরে উপভোগ করেছেন, অনেকে আবার আমার দেখা জায়গাগুলোর চেয়েই আরো সুন্দর জায়গায় গিয়েছেন তারপরও স্মৃতি গুলোকে ঝালাই করে নেয়া।
ঐ যে আমরা একসময়ের প্রমীলা আইনজীবী ভ্রমনপিয়াসীরা ছয়জনের যাত্রা। তবে এক অজানা প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পরে আমাদের ঘর ভেঙ্গে গেছে আমরা বেড়াতে যাইনা যাবোওনা আর কোনদিন। তাই স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো। মার্চের ছুটিতেই আমরা বেড়াতে বের হই।পরিকল্পনা করলাম কোলকাতা বেড়াবো,বাজার করবো,কোলকাতার আশপাশ ঘুরবো।কোলকাতা মারকুইস স্ট্রিট আমরা বেছে নেই প্রথমত নিউমার্কেট, খাওয়া দাওয়ার সুবিধা , পরিচিত সবার সাথে দেখা হয়ে যায় বলে।
কোলকাতা পৌঁছাবার পর মানিএকচেন্জ করতে গেলাম শ্যামলী ট্রাভেল এজেন্সী তে ছয়জন মিলে তখন বাজে ১.০০।। আমাদের হাতে একসপ্তাহ সময় এর মধ্য একজন প্রস্তাব করলো সাতদিন আমরা কোলকাতা কি করবো? চলো দিল্লী,আগ্রা, রাজস্থান,আজমীরশরীফ ঘুরে আসি।যেমনি কথা তেমনি কাজ।ওখানে দাঁড়িয়ে বললাম আজকের ট্রেনের টিকেট দেয়া যাবে ছয়টি। এজেন্সি র লোকেরা বললো দেয়া যাবে আজকে সাড়ে চারটার রাজধানী এক্সপ্রেস,তবে টাকা বেশী দিতে হবে।
আমরা রাজি হয়ে টিকেট কিনে ফেললাম।টিকেট নিচ্ছি তখন দুটো বাজে।এরমাঝে নাওয়া খাওয়া কিছু হয়নি সাথে সবার বেশ বড় দুটো করে লাগেজ। প্রথমেই ছোট ব্যাগে কিছু কাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিস ঢুকিয়ে বাকী সব ট্রাভেল এজেন্টের কাছে জমা দিলাম।সে দিল্লীতে হোটেল রিজেন্ট মালিক রাজা বাবুর ফোন নাম্বার দিয়ে কানেক্ট করিয়ে দিলো।ওনি দিল্লী স্টেশন থেকে আমাদের রিসিভ করবে।।
তাড়াহুড়ো করে হোটেল কস্তুরীতে লান্চ করে করে একটা গাড়ী নিয়ে চলে গেলাম শিয়াল দা স্টেশনে।দৌঁড়েতে দৌঁড়াতে ট্রেন প্রায় ছেড়ে যাচ্ছে এ অবস্থায় ট্রেনে ব্যাগ টেনে নাক ঢুকালাম।রক্ষে পাঁচমিনিটের দেরী হলেই কল্লা ফতেহ পুরো টাকাই গায়েব টেনশন তো আছেই।যেহেতু ছজন থ্রি টায়ার কম্পার্টমেন্ট নিলাম সবাই একজায়গায় থাকবো বলে।। ট্রেনে ওঠার পরপরই শুরু হলো আপ্যায়ন চা বিস্কিটের শুরু একের পর এক খাবার আসছে আমরা খাচ্ছি,গল্প করছি,আমাদের সাথে ও বহুতি খাবার।রাত দশটায় ডিনারের পর্ব শেষ করে আইসক্রিম খাওয়া শেষে এক দীর্ঘ ঘুম,আহা ট্রেনের ঝিক ঝিক আওয়াজের মাঝেই হারিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে,আগের দিন জার্নি শুরু করেছিলাম বলেই ক্লান্ত অবসন্ন দেহে এতো ঘুম।সকাল বেলা চায়ে চায়ে , বিনা চিনি চায়ে, আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে দেখি সাতটা বেজে গেছে।নাস্তার অর্ডার নেয়ার পর ফ্রেস হয়ে নাস্তা গল্প করতে করতে আমরা ১০.৩০ দিল্লী পৌছানোর আগেই দেখি রাজা বাবুর লোকের ফোন আমরা কতো নাম্বার কম্পার্টমেন্টে আছি জেনে নিলো।
পৌঁছাবার সাথে সাথে আমাদের স্টেশন থেকে রিসিভ করে হোটেলে নিয়ে গেলো।বিকেলে আমরা মোটামুটি দিল্লী গেট,হুমায়ুনস টম্ব,কুতুব মিনার,পার্লামেন্ট ভবন,নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার আরো অনেক দর্শনীয় স্হান ঘুরে পরের দিন সকাল ছয়টায় রওয়ানা হলাম আজমীর শরীফ। আমরা ছয়জন আটসীটের একটি বড় গাড়ীতে করে যাত্রা শুরু করলাম।মনে ভয় ও উত্তেজনা নতুন জায়গা একজন সুফি সাধকের মাজার শরীফ দেখতে যাচ্ছি। অনেক গল্প সবার কাছে শুনেছি কেউ সন্তানের জন্য,কেউ মনোবাসনা পূরনের জন্য বিভিন্ন জন নিয়্যত করে মাজার শরীফে যায়। মনোবাসনা পূরন ও নাকি হয়।
আমাদের গাড়ী চলছে একটার পর একটা জায়গায় ঢুকছি কোন কোন শহরের উপর দিয়ে ফ্লাইওভার চলে গিয়েছে বেশ ভাল লাগছিল যে প্রভিন্সে ঢুকছি সব জায়গায় টোল দিতে হচ্ছে।। বিভিন্ন প্রভিন্স পার হওয়ার সময় তাদের পোশাক, এলাকার প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রান ভরে উপভোগ করছিলাম।আমাদের ড্রাই বার হিন্দি , ছাড়া কিছুই বুঝে-না আর আমরা ভাল হিন্দি বলতে পারিনা তবে আমাদের মেয়ে রশ্মি বেশ স্মার্ট, চটপটে সহযোগিতা করে যাচ্ছিল সারা পথ।। সকাল আটটায় আমরা গাড়ী থামিয়ে একটি ধাবায় সকালের নাস্তা ঝলসানো রুটি,ভাজি,আন্ডে,চা,কফি খেয়ে রওয়ানা হলাম।একসময় আমরা ধূ ধূ মরুভূমি পার হচ্ছিলাম। দূরন্ত গাড়ীর পাশে চারন ভূমিতে উট, আর উটের পিঠে বিভিন্ন পোশাক,পাগড়ী পরিহিত আরোহীদের দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছিলাম। মরুভূমির ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় বালির ঘূর্নন ও দূর থেকে দেখতে পেলাম।একসময় ড্রাইভার দূরে একটি সাদা পাহাড় দেখালো যেখান থেকে সংগৃহিত হয় মার্বেল পাথর পুরো ভারত সহ আশে পাশে এ পাহাড়ের মার্বেল পাথর এ পাহাড় থেকে সরবরাহ করা হয়।।আমরা মরুভূমির পথ ধরে চলছি তো চলছি।মার্চ মাস প্রচন্ড দাবদাহ।একসময় চায়ের তৃষ্ণা জাগলো একটি দোকানে থামলাম চা খেতে।।
গাড়ীর এসি থেকে নেমে যখনই দোকানের যাবো মনে হলো কে যেন আগুনের শেক দিচ্ছে গায়ে। কিসের চা খাওয়া একদৌড়ে সবাই গাড়ীতে।।বসে বসে ভাবছিলাম আমরা যেখানেএক সেকেন্ড দাঁড়াতে পারলাম না সেখানে মরুভূমির মানুষ গুলো কিভাবে থাকে? সবাই মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি অথচ আবহাওয়া,পরিবেশ, বর্ন,গোত্র,পোশাক,খাবার আর মানুষে মানুষে কতো পার্থক্য । কি তাদের শারীরিক সক্ষমতা।দুপুর একটায় সময় আমরা পৌঁছে গেলাম গরিবে নেওয়াজ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রহঃ এর মাজার এলাকায়, যিনি সবচেয়ে বিখ্যাত সুফি সাধক।
আমাদের গাড়ী ভিতরে ঢুকলো না আমরা গাড়ী থেকে নামলাম নেমে হেটে কিছুদূর গিয়েই একটা ধাক্কা খেলাম।আমরা একজন সুফি সাধকের পবিত্র স্থানে যাচ্ছি রাস্তায় ভরা খচ্চর,জায়গা জায়গায় তাদের বিষ্টা।।।এরপর চলে এলাম মাজার গেটে সরকারী ভাবে কিছু টাকা দিয়ে জুতো রেখে ঢুকা যায় আমরা বুঝতে পারিনি।।ইতিমধ্যে দুজন লোক এলো বললো ফুল কিনতে হবে তাহলে জুতো রাখবে।যাহোক পবিত্র জায়গায় এসে বেয়াদবি করা যাবেনা,ফুল কিনে জুতা খুলে যেই না মাটিতে পা দেবো পুরো এলাকা টাইলস করা টাইলস গুলোতে ডিম দিলো নির্ঘাত পোজ হয়ে যাবে।আগুন গরম টাইলস দিয়ে কিভাবে পার হবো? মনে হলো দোজখের শাস্তির কথা সে আগুন তো আরো ভয়ংকর, আরো কঠিন হবে।
একসময় আল্লাহকে ডেকে পায়ের গোড়ালিতে ভর করে এগিয়ে গেলাম। এর মাঝে একজন এসে টার্গেট করলো তাকে টাকা দিতে হবে তাহলে সে আমাদের ভিতরে নিয়ে যাবে। হিন্দু, মুসলিম,বৌদ্ব খ্রিস্টান শত মানুষের উপস্হিতি।এর মাঝে জোহরের আজান হলো,আমরা ওজু করে নামাজের সারিতে বসেছি চোখ ঘুরিয়ে দেখি আমাদের এক কাতার পরে বসে আছেন বর্তমান বিচারপতি কামরুল কাদের রিপন সাহেব।।তখন আইনজীবী ছিলেন,আমি বললাম কোথাও রক্ষা নেই সব জায়গায় উকিলদের দেখা পাবোই।। ওনি আমাদের দেখে খুশি হলেন।
পরে ওনাকে টাকা চাওয়া লোকটির কথা বললাম ওনি বললেন দিতে হবে। আমাদের ইচ্ছে ছিল মাজারের সামনে রাখা বিরাট হাঁড়িতে হাদিয়া দিবো যা ওরস শরিফে খরচ হয়।পরে ঐ লোককে টাকা দেয়ার পর সোজা লাইনে না নিয়ে বাকাঁ পথে আমাদের নিয়ে গেলো।আমরা মোনাজাত করলাম,ওনার জন্য দোয়া করলাম।আমি মানতে বিশ্বাসী না সব দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ।এখানে আসার পূর্বে আমি পবিত্র হজ্জ ব্রত পালন করে এসেছিলাম।
সুফী সাধক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি তাঁর হাত ধরে বহু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছেন।তাঁর অলৌকিক কিছু কাজ এবং গরীবের প্রতি তার দরদের কথায় তাঁর প্রতি অনুরক্ত।। যারা ধর্মের জন্য নিবেদিত ছিলেন তাঁদের শ্রদ্ধা করি, মন থেকে দোয়া করি,আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আমি ধর্মভীরু কিন্ত ধর্মান্ধ নই।। আমাদের দেশে,বিদেশে মাজার সমূহের ভিতরে মাজারের নামে মানুষ দের বেদাতি কার্যক্রম আসলে মেনে নেয়া কঠিন।কামেল ব্যক্তিটি বলে যাননি এ গুলো করার জন্য।
জোহরের নামাজ আদায়ের পর আমরা খুব মজার একটা জরদা খেলাম তবারক হিসেবে,কি মজার খাবারটি ছিলো সব রকমের বাদাম,পেস্তা,কিসমিস,খাঁটি ঘিয়ের তৈরী খাবারটি আজো মুখে লেগে আছে।।পরে হাঁড়িতে কিছু হাদিয়া দিয়ে, নিজেদের জন্য,বাবা মা আত্মীয় স্বজন দের জন্য দোয়া করে দুপুরের লাঞ্চ সেরে রওয়ানা হলাম পিংক সিটি জয়পুররে উদ্দেশ্যে।। আল্লাহ সবার মনোবাসনা পূর্ন করুন। রাত কাটানো জয়পুরে।
চলবে……………..