মানুষ ,নৈতিকতা ও মানবতা: তৈমূর আলম খন্দকার

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ পত্রিকান্তরে প্রকাশিত কিছু সংবাদ পড়ে মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে কাজগুলো করা সম্ভব হয় কিভাবে? জাতীয় পত্রিকান্তরে ৪ জুন ২০১৯ একটি সংবাদ প্রকাশ হয় যা নিম্নরূপ : “রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকার বাসিন্দা জামান (ছদ্মনাম)। জীবনের পড়ন্ত সময়ে আশ্রয় নেন আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাস ‘বৃদ্ধাশ্রমে’। এখানে জীবনের শেষ ২০ বছর কেটেছে। আপনজনদের নিয়ে অসংখ্য স্মৃতি-কষ্টের ঝড় এতটা বছর একা একা বয়ে বেড়িয়েছেন।

কিন্তু সন্তানরা এক দিনও দেখতে আসেনি। ফলে যে বয়সে নিজেকেই নিজের কাছে বোঝা মনে হয়, সে বয়সে স্বজনহীন কষ্টের বোঝা বহন তার জন্য অসহ্য হয়ে গিয়েছিল। ফলে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কান্না-আহাজারি ছিল তার একমাত্র সঙ্গী। এ রকম অবস্থায় সম্প্রতি এই প্রবীণ বৃদ্ধাশ্রমেই মারা যান। নিয়মানুযায়ী তার স্বজনদের জানাতে প্রথমেই তার এক ছেলেকে ফোন দেয়া হলো। ফোন ধরে ছেলে জানাল, তিনি তাবলিগ জামাতে আছেন। লাশ নিতে আসতে পারবেন না। তার পরও বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও বাবার লাশ নিতে রাজি করাতে পারলেন না।”

জাতীয় দৈনিকে ১৭ জুন ২০১৯ প্রকাশিত একটি সংবাদ, যা নিম্নরূপ :
‘আড়াইহাজারে মাদকের টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে নিজের বৃদ্ধা মাকে পিটিয়েছে শাহাবল (২৫) নামে এক যুবক। শনিবার (১৫ জুন) রাত ১১টার দিকে উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়নের খানপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত মায়ের নাম রাহিমা বেগম (৬৫)। রোববার (১৬ জুন) দুপুরে আহত মা রাহিমা বেগম মাদকাসক্ত ছেলের হাত থেকে বাঁচার জন্য আড়াইহাজার থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। আড়াইহাজার থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শনিবার রাতে আমির হোসেনের ছেলে শাহাবল তার মা রাহিমা বেগমের কাছে মাদক কেনার টাকা দাবি করে।

মা মাদকাসক্ত ছেলের দাবি অনুযায়ী টাকা দিতে অস্বীকার করলে ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলে শাহাবল লাঠি দিয়ে তার বৃদ্ধা মাকে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে। রাতেই বাড়ির লোকজন আহত মাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনে চিকিৎসা দেন। আহত রাহিমা বেগম জানান, তার ছেলে শাহাবল প্রতিদিনই মাদক সেবন করে থাকে। তার হাতে মাদকের টাকা না থাকলেই সে তার কাছে মাদকের টাকা দাবি করে। তার চাহিদা মতো টাকা না দিলে মাদকাসক্ত শাহাবল তাকে মারধর করে।

১৮ জুন ২০১৯ জাতীয় পত্রিকায় আরো একটি সংবাদ প্রকাশ হয়, যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
‘চুয়াডাঙ্গা জেলাধীন আলমডাঙ্গা উপজেলার সোনাতনপুর গ্রামের মামুন আলীর স্ত্রী মানসিক রোগী সামিয়া খাতুন আড়াই বছরের তার শিশুকন্যা সিনহাকে বাড়ির ছাদে নিয়ে বঁটি দিয়ে জবাই করে হত্যা করেছে। ১৭ জুন ২০১৯ সোমবার সকালে প্রতিবেশীরা জানতে পারে যে, সামিয়া তার তিনকন্যা সন্তানের মধ্যে সবার ছোট সিনহাকে বাড়ির ছাদে রাতে হত্যা করেছে। প্রতিবেশীরাই পুলিশে খবর দিলে আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ সিনহার গলা কাটা লাশ উদ্ধার এবং খুনি মা সামিয়াকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। জানা গেছে, কিছু দিন আগে সামিয়া আরেকবার কন্যা সিনহাকে হত্যা করতে গিয়েছিল। বাড়ির অন্য লোকজনের নজরদারিতে পারেনি। গত রাতে স্বামীসহ বাড়ির লোকজন যখন ঘুমে ছিল তখন ডাইনি মা সিনহাকে বাড়ির ছাদে নিয়ে বঁটি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করল।’

গ্রামগঞ্জের সব খবর পত্রিকায় বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আসে না। তার পরও বর্তমানে মিডিয়ার কল্যাণেই মানুষ ও সরকার যা কিছু জানতে পারছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ হচ্ছে না এমনটি নয়। তদুপরি প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ময়নাতদন্ত বা পুলিশি তদন্তের রিপোর্ট পাল্টে যায়। যেমনটি দেখা যায় সিনেমার পর্দায়, তেমনটি বাস্তব ক্ষেত্রেও হচ্ছে। মিডিয়ার কারণে সাত খুনের মামলার বিচার হয়েছে, ত্বরান্বিত হয়েছে নুসরাত হত্যার বিচার। ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন আজ জেলখানায় মিডিয়ার বদৌলতে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মিডিয়াকর্মী সাগর-রুনির হত্যার বা তনু হত্যার কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি সরকার। সবার ধারণা, প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারণেই বিচারব্যবস্থা এ পরিস্থিতির শিকার।

এ তো গেল প্রতিহিংসাপরায়ণ, স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা পাওয়া-না-পাওয়ার জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড, যা নানাবিধ ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ; অন্য দিকে, দোষী না হলেও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আসামির কাঠগড়ায় অনেককেই দাঁড়াতে হয়। কিন্তু বাবা-মা কর্তৃক সন্তান খুন, সন্তান কর্তৃক বাবা-মা খুন এগুলো তো ষড়যন্ত্রের বা হিংসা-প্রতিহিংসার আওতায় আসতে পারে না। তবে কেন এ অপরাধ দিন দিন বাড়ছে?

গত মে মাসেই অভাবের তাড়নায় এক পিতা নরসিংদী লঞ্চঘাটে ল্যাট্রিনের মধ্যে দুই শিশুকন্যাকে গলা টিপে হত্যা করে। জেলা পুলিশ সুপার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন। প্রাগ-ইসলামী যুগে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়ার ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে কি মানুষ ১৫০০ বছর আগের বর্বরতার সংস্কৃতিতে ফিরে যাচ্ছে?

তবলিগে থাকায় পিতার লাশ গ্রহণে অপারগতা কী প্রমাণ করে? পবিত্র কুরআন এবং হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নির্দেশনা মোতাবেক আল্লাহ পাকের পর কাউকে যদি সেজদাহ করার বিধান থাকত তবে অবশ্যই পিতা-মাতাকে সিজদাহ করার হুকুম আসত। তবলিগ জামাত যেখানে নিজেদের ইসলাম ধর্ম অনুশীলনের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি মনে করে, সেখানে তবলিগে থাকায় পিতার লাশ দাফন না করার অজুহাত কি গ্রহণযোগ্য? এ ধরনের ঘটনাকে অনেকেই মানসিক সমস্যা মনে করছেন; কিন্তু মানসিক সমস্যার কতটুকু গভীর হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে? অভাবই কি এর একমাত্র কারণ হতে পারে? নৈতিকতা ও মানবতা শব্দ দু’টি কি শুধু ডিকশনারিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, না মানুষের প্রবৃত্তির মধ্যে প্রবেশ করবে? সব মানুষই নৈতিকতা ও মানবতা বিবর্জিত, তা বলা যাবে না। তবে সংখ্যা দিন দিন ঘুচে যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ, যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রচেষ্টা।

অবস্থার প্রেক্ষাপটে অনেকসময় প্রয়োজনীয় বিষয় অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়, আবার কখনো অপ্রয়োজনীয় বিষয় প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সমস্যা যখন দানা বাঁধে তখন ক্ষুদ্র আকারেই সৃষ্টি, যা বৃদ্ধি পেতে দিনক্ষণ লাগে না। পঞ্জিকা দেখে শুভ-অশুভ লক্ষণ বা লগ্ন নির্ধারণ হয়ে আসছে কোনো কোনো ধর্ম মতে, কিন্তু কোনো বিষয় মহামারীতে পরিণত হতে দিনক্ষণ ও লগ্নের প্রয়োজন হয় না। ফলে সমস্যা গভীরভাবে দানা বাঁধার আগেই সমাধানের পন্থা খোঁজা বাঞ্ছনীয়।

লেখক : সদস্য, বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here