ইতিহাসে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবস্থান অতুলনীয়

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ পীর আবদুল মান্নান: আজ ৩০ মে,বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে তিনি নিহত হন। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। প্রতিবছর এ দিনটি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী হিসেবে পালন করে বিএনপি।  জেনারেল জিয়াউর রহমানকে স্মরণ করা দরকার তার দুর্দান্ত সাহসী দেশপ্রেমিক ভূমিকার জন্য এবং সঠিক ইতিহাসের স্বার্থে। এর কারণ সম্ভবত উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার জাতিকে এমন এক ‘সঠিক’ ইতিহাসই শিখিয়ে চলেছে যে ইতিহাসে ঘুরে-ফিরে শুধু একজনমাত্র নেতা প্রাধান্যে আসছেন। সরকার ও তার সমর্থকদের বক্তব্য ও কর্মকান্ডে মনে হতে পারে যেন দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং জাতিকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেয়ার পেছনে অন্য কারো কোনো অবদান নেই! অতি সংকীর্ণ এ মনোভাব থেকে সম্প্রতি স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে মওলানা ভাসানীর ইতিহাসও বাদ দেয়া হয়েছে- যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানেরও নেতা ছিলেন। মূলত ক্ষমতাসীনদের বিচিত্র ও এক নেতাসর্বস্ব নীতি-মনোভাব ও কর্মকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমান প্রজন্মসহ জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা দরকার। সে ইতিহাস জানাতে হবে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে, অবশ্যই হৃদয় ও মস্তিষ্ক থেকে নয়।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা শুধু নন, তাদের বদৌলতে রাষ্ট্রের উচ্চতর প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেয়ে যাওয়া বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর পক্ষ থেকেও ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে এই চেষ্টা চালাতে গিয়ে জিয়াউর রহমানকে বিতর্কিত তো করা হচ্ছেই, তার বিরুদ্ধে এমনকি সংবিধান লংঘন এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগও আনা হয়েছে। তাদের উদ্যোগে জিয়াকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে। যেমন কোনো এক উপলক্ষে চিহ্নিত এই বিশেষজনেরা নিজেদের মতো করে ইতিহাসের ব্যাখ্যা হাজির করতে গিয়ে বলেছেন, দেশে প্রথমবারের মতো সামরিক শাসন জারির জন্য খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান দায়ী।

তাদের মতে ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ নাকি সংবিধানকে নিম্ন মর্যাদায় ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছেন! এর ধারাবাহিকতায় এরশাদও একই অপরাধে অপরাধী হয়েছেন। বিশেষজনেরা আরো বলেছেন, জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলস্তম্ভ ভঙ্গ করেছিলেন। এরশাদও জিয়ার পথ অনুসরণ করে এই ভঙ্গস্তম্ভ নিয়ে দেশ চালিয়ে গেছেন। ইতিহাসের আওয়ামী ধরনের ব্যাখ্যার পাশাপাশি অন্য কিছু বিষয়েও বিশেষজনেরা বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু বলেননি, ‘ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে’ এরশাদের বিচার না হওয়ার পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা।

প্রথমে চিহ্নিত ওই বিশেষজনদের সংবিধান সংক্রান্ত বক্তব্য লক্ষ্য করা যাক। তারা বলেছেন, জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলস্তম্ভ ভঙ্গ করেছিলেন আর এরশাদ সে ভঙ্গস্তম্ভ নিয়েই দেশ শাসন করে গেছেন। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এমন ঢালাও মন্তব্যকে সমর্থন করে না। কারণ, বিশেষজনেরাই আবার একথাও বলেছেন, ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। খন্দকার মোশতাক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাকশাল মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। কথাটার মাধ্যমে প্রকারান্তরে কিন্তু এ সত্যই উচ্চারিত হয়েছে যে, প্রথমবারের মতো সামরিক শাসন জারি এবং মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বাস্তবে ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার যে বিপ্লব দেশের মানুষকে বাকশালসৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই বিপ্লবকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে।

প্রধান নেতা হিসেবে বেরিয়ে এলেও জিয়া ওই বিপ্লবের স্রষ্টা ছিলেন না। বাস্তবে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর মিলিত প্রতিরোধ ও পদক্ষেপের ফলেই ৭ নবেম্বরের সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। বহুদিন পর এদেশের ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর সে ঐক্য প্রমাণ করেছিল, দেশ ও জাতির যে কোনো দুঃসময়ে দেশপ্রেমিকরা ঐক্যবদ্ধ হন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এজন্য তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিক থেকে সিদ্ধান্ত বা আহবানের অপেক্ষা করেন না। ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বরও নিজেদের তাগিদেই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে পা বাড়িয়েছিলেন বলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করা এবং বাংলাদেশকে দেশ বিশেষের পদানত করে ফেলা সম্ভব হয়নি।

বিশেষজনেরা পাশ কাটালেও ইতিহাসের সত্য হলো, সবকিছুর পেছনে ছিল বাকশালের একদলীয় শাসন। সে বছরের অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবেরই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ। শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের নিয়েই মোশতাক সরকার গঠন করেছিলেন। ৩ নবেম্বর অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। সেনাবাহিনীতে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ও জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করে তিনি সেনা প্রধানের পদ দখল করেছিলেন। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থান বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার ভারতপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল।

ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। ফলে জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ৬ নবেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবে খালেদ মোশাররফ মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও জাসদের নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠীর উদ্যোগে সেনা অফিসারদের হত্যার কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। অফিসার মাত্রই খালেদ মোশাররফের সমর্থক- এমন এক প্রচারণায় বিভ্রান্ত সৈনিকদের হাতে বেশ কিছু অফিসারের মৃত্যু ঘটেছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছিলেন জিয়াউর রহমান।

বস্তুত ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নবেম্বর পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে শুধু নয়, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট অনেকের স্বীকারোক্তি এবং তথ্য-প্রমাণেও সুনির্দিষ্টভাবেই জানা গেছে, স্বাধীনতা ধ্বংস করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে দেশ বিশেষের অধীনস্থ করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি ঘটানোর এবং হানাহানি উস্কে দেয়ার ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। সিপাহীরা গরীবের সন্তান ও অল্প শিক্ষিত বলে ধনীর সন্তান অফিসাররা তাদের ওপর নির্যাতন চালান এবং সিপাহী ও অফিসারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকা অন্যায়- এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক স্লোগান তুলেছিল তারা। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ছিল। একযোগে অফিসার মাত্রকেই হত্যা করার নিষ্ঠুর অভিযানও শুরু হয়েছিল। সকল বিষয়ে নির্দেশনা আসছিল একটি বিশেষ কেন্দ্র থেকে। সেখানে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান।

তার সঙ্গে ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নেয়া পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীর উত্তম। কর্নেল তাহের নিজেকে বঞ্চিত মনে করতেন। তার এ মানসিক বৈকল্যেরই সুযোগ নিয়েছিল জাসদসহ ষড়যন্ত্রকারীরা। কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে তারা এমনভাবেই অফিসার হত্যা চালাতে চেয়েছিল যার পরিণতিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে একমাত্র তাহের ছাড়া অন্য কোনো অফিসার থাকতে পারতেন না। আর তাহের নিজে যেহেতু জাসদের মাধ্যমে স্বাধীনতা ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন, সেহেতু স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের সশস্ত্র বাহিনী অফিসারবিহীন হয়ে পড়তো। পরিণতিতে সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া দেশ বিশেষের জন্য কোনো ব্যাপারই হতো না। ওই ষড়যন্ত্রে ও কর্মকান্ডে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সম্পর্কে বেশি বলার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, সে বছরের ১৫ আগস্ট বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন অফিসার শেখ মুজিবকে হত্যা করলেও আওয়ামী লীগ গোটা সেনা বাহিনীকেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। দলটি চাইত না, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী টিকে থাকুক এবং শক্তিশালী হোক।

কিন্তু জাতির ভাগ্য ভালো, সিপাহী এবং নন-কমিশন্ড অফিসারদের সমন্বয়ে সেনা বাহিনীরই একটি অংশ সেনা প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি তাদের আস্থাও ছিল সীমাহীন। ফলে জেনারেল জিয়া সম্পর্কে সশস্ত্র বাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়নি। জেনারেল জিয়াও সততা ও বলিষ্ঠতার সঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ঝটিকা সফরে গেছেন তিনি। বলেছেন, তার এবং সিপাহী ও নন-কমিশন্ড অফিসারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই একই মাতৃভূমির জন্য কাজ করছেন তারা। জিয়াউর রহমানের মতো একজন জনপ্রিয় জেনারেলের এই তৎপরতা ও বক্তব্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনতিবিলম্বে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল।

ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে অনেকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও ছিল। ফলে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও দ্রুত প্রচারিত হয়েছিল যে, অফিসার হত্যার অভিযানে দেশ বিশেষের ভূমিকা রয়েছে। দেশটি কেন অফিসারদের হত্যা করতে চায়- সেকথা তাদের বুঝিয়ে বলতে হয়নি। মূলত এসব কারণেই জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চেইন অব কমান্ড। বড় কথা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী সশস্ত্র বাহিনীকে নির্মূল করে ফেলা সম্ভব হয়নি।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রধান অবদান। স্বাধীনতার পর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ‘বাকশাল’ নামে একটি মাত্র দল রেখে অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাতারাতি তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে বসেছিলেন। বাকশালেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। বাকশালের গঠনতন্ত্রে সকল ক্ষমতা এই চেয়ারম্যানের হাতে দেয়া হয়েছিল।

এভাবে শেখ মুজিব একই সঙ্গে দেশের রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ধারণা দেয়া হয়েছিল, তিনি আজীবন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, তাকে কেউ সরাতে পারবে না। এর মধ্য দিয়ে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর ধরনের স্বৈরশাসন। শেখ মুজিব এবং বাকশাল বা সরকারের বিরুদ্ধে তখন টুঁ শব্দটি করারও উপায় ছিল না। এই সুযোগে আওয়ামী-বাকশালীরা সারাদেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং বিরোধীদের উচ্ছেদের জন্যও নিষ্ঠুর অভিযান চালিয়েছিল তারা। ৪০ হাজারের বেশি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবাদ জানানোর তখন উপায় ছিল না। সমগ্র জাতি বন্দি হয়ে পড়েছিল।

১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর দেশ ও দেশের মানুষকে ওই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আগত জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে খুলে দিয়েছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের দরজা। এই পথ ধরেই বাতিল ঘোষিত দলগুলো আবারও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নামে শেখ মুজিব যে ইসলামী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করেছিলেন জিয়াউর রহমান সে দলগুলোকেও রাজনীতি করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

শেখ মুজিব চারটি দৈনিক ছাড়া সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করেছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সরকারের অধীনে চলে যাওয়া দৈনিক ইত্তেফাক মালিকরা ফিরে পেয়েছিলেন। বাজারে এসেছিল নতুন অনেক দৈনিক ও সাপ্তাহিকসহ পত্রপত্রিকা। ওদিকে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার আমলেই প্রথমবারের মতো দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৮), তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল ছোট-বড় এবং নতুন ও পুরনো সব দল- যেগুলোর মধ্যে জিয়ার নিজের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি ছাড়াও মুসলিম লীগ এবং ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশের সংবিধানে জিয়াউর রহমান ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করেছিলেন। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সকল কাজে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে বাধ্যতামূলক করাও ছিল জিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ‘বালাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর প্রবর্তন করেও তিনি অমর হয়ে রয়েছেন।

এখানে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার ব্যাপারে জিয়ার নেয়া ব্যবস্থা সম্পর্কেও বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। এটা ১৯৮১ সালের ঘটনা। দেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। একই আওয়ামী লীগ নাম নিয়ে সে সময় ব্র্যাকেটবন্দী তিনটি দলের আবির্ভাব ঘটেছিল। আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন দলটি প্রধান আওয়ামী লীগের অবস্থান অর্জন করেছিল। কিন্তু সেখানে সভাপতির পদ নিয়ে সংঘাত মারাত্মক হয়ে ওঠে। আপস ফর্মুলা হিসেবে শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী বানানো হয়।

শেখ হাসিনা তখন ভারতের আশ্রিতা হিসেবে নয়াদিল্লিতে বসবাস করছিলেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার পর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন ওঠে। মহল বিশেষের পক্ষ থেকে পানি ঘোলা করার চেষ্টা চালানো হলেও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবাধে দেশে ফিরতে এবং বসবাস করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই ঘোষণার পরই নয়াদিল্লি থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয় (১৭ মে, ১৯৮১)। জিয়া শুধু শেখ হাসিনাকেই ফিরিয়ে আনেননি, তাকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত তার পৈত্রিক বাসভবনও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

জিয়ার নির্দেশে বাসভবনের প্রতিটি জিনিসের বিস্তারিত তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সে তালিকায় শেখ মুজিবের পাইপ ও চশমা, শেখ কামাল-জামালের সোনার মুকুট, অলংকার, নগদ টাকা, মার্কিন ডলার, ভারতীয় রূপী, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং কাপড়-চোপড় ও আসবাবপত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল লাইসেন্সবিহীন কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং সেসব অস্ত্রের গুলীও। শেখ হাসিনা প্রতিটি জিনিস তালিকার সঙ্গে একটি একটি করে মিলিয়ে ও যাচাই করে তারপর লিখিতভাবে বুঝে নিয়েছিলেন। স্বর্ণকার দিয়ে সোনার মুকুট ও প্রতিটি স্বর্ণালংকার ওজন করিয়ে এবং রীতিমতো ‘বাজিয়ে’ নিয়েছিলেন। তিনি শুধু আগ্নেয়াস্ত্রগুলো বুঝে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, একই নেত্রী শেখ হাসিনা এবার ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্ত্রী ও সন্তানদের ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উৎখাত করে ছেড়েছেন। একেই সম্ভবত কৃতঘ্নতা বলে। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে আর চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে জিয়ার মৃত্যু ঘটেছিল ৩০ মে।

এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, হুকুম তামিল করতে গিয়ে চিহ্নিত বিশেষজনেরা যা কিছুই বলুন না কেন, সব মিলিয়ে প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে রেখে গেছেন জিয়াউর রহমান। অন্যদিকে এরশাদ ছিলেন সকল ব্যাখ্যাতেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী। দূরপ্রসারী অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এমনভাবে জিয়ার পদাংক অনুসরণের অভিনয় করেছিলেন, যাতে জিয়াকে নিন্দিত করা যায়। আওয়ামী ঘরানার ওই বিশেষজনেরাও এরশাদের সে কৌশলের জালেই আটকে গেছেন। এজন্যই তারা এমন এক বিচিত্র ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, যা পড়ে যে কারো মনে হবে যেন জিয়া ও এরশাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! অথচ ইতিহাসের সঠিক ব্যাখ্যায় প্রমাণিত হবে, জিয়ার সঙ্গে কোনোদিক থেকেই এরশাদের তুলনা চলে না।

তাছাড়া আগেও বলা হয়েছে, ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারি করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাকশাল মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদ। অর্থাৎ সামরিক শাসন জারি এবং মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ ধরনের উল্লেখ ও মন্তব্যও তাই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তা সত্ত্বেও জিয়ার মতো একজন মহান দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে নিন্দা-সমালোচনার পাহাড় তৈরি করার কর্মকান্ড চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে প্রমাণিত সত্য হলো, প্রধান নেতা গ্রেফতারবরণ করার এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা পালিয়ে যাওয়ার পর স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জনগণ যখন চরম অনিশ্চয়তা ও হতাশার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল তেমন এক কঠিন সময়ে, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

তার এই ঘোষণা সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ পেয়েছিল প্রচন্ড গতিবেগ। একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবেও জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সবশেষে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানই জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে রেখে গেছেন। এজন্যই সুপরিকল্পিত অপপ্রচার চালানো হলেও সমগ্র জাতি তাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। তার উদ্দেশ্যে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here