না’গঞ্জের ফতুল্লায় জঙ্গী আস্তানা নিয়ে পরিবার ও এলাকাবাসীর দ্বিমত

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার শিহারচরের নিজ বাড়ি থেকে জঙ্গি কর্মকান্ডে ব্যবহৃত বিস্ফোরক ও আলামত পাওয়ার প্রশাসনিক তথ্য সম্পর্কে ভিন্নমত পোষন করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম জয়নাল আবেদিন। মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তিনি ফতুল্লার নিজ বাড়িতে এসে তিনি প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু তদন্ত দাবী করেন। কিভাবে কি ঘটলো কিছুই বুঝতে পারছি না। ৭ দিন আগেও যখন বাড়ি তালা মেরে যাই তখনো চৌকি আর ঘাস পরিস্কার করার কাচি ছাড়া কিছুই ছিল না। যা বলা হচ্ছে এ ৭দিন কারা আনলো এত কিছু। ২৩ সেপ্টেম্বর সোমবার অভিযানের পরেই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তালা ঝুলিয়ে রেখেছে।

অভিযানের সময়ে এ বাড়িতেই ঘটে চারটি বিস্ফোরণ। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দাবী এ বাড়িটি নব্য জেএমবির ল্যাব হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গত এপ্রিল হতে এখন পর্যন্ত রাজধানীতে পুলিশের উপর যেসব হামলা হয়েছে তার প্রত্যেকটির সঙ্গে এ ল্যাবের যেমন সম্পর্ক আছে তেমনি গ্রেফতারকৃত জামালউদ্দিন রুমি ও মিশুক হোসেন মিজানের সম্পৃক্ততা আছে। তাদের দাবী হামলায় যেসব বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রত্যেকটির সঙ্গে সোমবার উদ্ধারকৃত বিস্ফোরকের মিল রয়েছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ি হতে রবিবার রাতে মিজানকে গ্রেফতারের পর তার দেওয়া তথ্য মতেই সোমবার ভোরে ফতুল্লার শিহারচর থেকে রুমিকে গ্রেফতার করা হয়। আটক করা হয় তার স্ত্রী জান্নাতুল ফোয়ারা অনুকেও। পরে অভিযান চলে শিয়ারচরের তাদের বাড়িতে। ইতোমধ্যে পুলিশ জানিয়েছে মিজান ও রুমি নব্য জেএমবির সদস্য।

গুলিস্তানে পুলিশকে টার্গেট করে আইইডি হামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। রুমির আরেক ভাই জামালউদ্দিন রফিককে আটকের কথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা স্বীকার না করলেও পরিবার বলছে একই সঙ্গে তাকেও নিয়ে গেছে। জয়নাল আবেদিন বলেন, আমার দুই ছেলে ফরিদ উদ্দিন রুমি ও জামাল উদ্দিন রফিক ও ছেলে বউ জান্নাতুল ফোয়ারা অনু। রবিবার দিনগত রাত অনুমান ১টায় এ তিনজনকে আমার বাসা থেকে নিয়েছে। তখন আমরা এখানে ছিলাম না। আমি ও আমার স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। প্রতিবেশীরা ফোনে রবিবার রাত ২টার দিকে আমাকে জানিয়েছে এ ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেশীরা বলে আপনার বাসায় তল্লাশী করছে ও ভাংচুর করছে। তবে ফতুল্লা থানায় তাদের নেওয়া হয়নি ঢাকা থেকে পুলিশ এসে নিয়েছে।

১৯৮১ সালে জায়গা কিনে ১৯৮৫ সালে বাড়ি করি। যে বাড়ি থেকে ধরে নিয়েছে সেটাই আগে কিনে বাড়ি করি। পরে যে বাড়িতে অভিযান হয়েছে সেটা কিনেছি। ভাড়া দেওয়ার জন্য টিনসেডের রুম করে দেই। সেখানে কেউ থাকে না। আমার ছোট ছেলে রফিক সেখানে থাকে মাঝে মাঝে ও দেখাশোনা করে। বাড়িতে যেহেতু লোকজন নেই কিন্তু সেখানে পানির পাম্প, রান্নার চুলা সহ আসবাবপত্র আছে। সেজন্যই মাঝে মাঝে সেখানে থাকে। কোরবানী দুটা ছাগল কেনা হলে ওই ছাগলগুলোর ঘাস খাওয়ানোর জন্য ওই বাড়িতে রাখা হয়। সে সময় কয়েকদিন ওখানে ছিল। এছাড়াও বাড়িতে আত্মীয় স্বজন আসলে জায়গা হতো না তখন সে ওখানে থাকতো।
জয়নাল আবেদিন বলেন, ভাড়াটিয়া থাকার মতো পরিবেশ নাই। বৃষ্টি হলে চালা দিয়ে পানি পড়ে আর পানি জমে থাকে যার জন্য ভাড়াটিয়ারা চলে যায়। সবাই যাওয়ার পরও একজন ভাড়াটিয়া ছিল। এছাড়াও ভবন নির্মাণের জন্য চিন্তাভাবনা ছিল সেজন্য এখানে মাটি পরীক্ষা করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে জয়নাল আবেদিন বলেন, ১৪ সেপ্টেম্বর আমি সেখানে গিয়ে ঘাস পরিস্কার পরিচ্ছন্নের জন্য তার রুম খুলি। সেখানে একটি কাস্তে, নিড়ানী ছিল সেটা দিয়ে ঘাস পরিস্কার করি লাউ গাছের চারা লাগানোর জন্য। এছাড়াও বাড়ির সামনের ঘাসগুলোও পরিস্কার করি। তারপর দিন ১৫ সেপ্টেম্বর আমি গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। কিন্তু তার রুমে এসব কোন কিছুই দেখি নাই। রেফ্রিজেরেটরের কথা শুনেছি, কিন্তু এখানে ফ্রিজ থাকার প্রশ্নই আসে না। এগুলো কিভাবে কি হয়েছে আমি বলতে পারছি না। ১৪ সেপ্টেম্বর আমি রুম খুলেছি কিন্তু আমার নজরে এসব কিছুই পড়েনি। এখানে ৬টা রুম। যার মধ্যে উত্তর দক্ষিনে দুটা রুম আর পূর্ব পশ্চিমে ৪টি রুম। পূর্ব পশ্চিমের ৪টি রুমের প্রথমটিতে আমার দেখা একটা চকি, টেবিল, চেয়ার ও বিছানা ও জামা কাপড় ছিল।

ছেলেদের প্রসঙ্গে জয়নাল আবেদিন বলেন, তাদের মধ্যে হঠাৎ করে কোন পরিবর্তন দেখি নাই। আমার মনেও পড়ে না। তারা স্কুল, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে এমন কোন কিছু দেখি নাই। এছাড়া সব সময় নামাজ আগে থেকেই পড়ে। তাদের আমি আগেই সব সময় বলেছি যে, সন্তান হয় নেয়ামত কিংবা কেয়ামত। ছেলে যদি ভালো হয় তাহলে বাবা মায়ের জন্য নেয়ামত আর যদি খারাপ হয় তাহলে কেয়ামত। প্রতিবেশী ও এলাকাবাসী আছে তারা কেউ বলতে পারবে না, আমার ছেলেরা খারাপ, মারামারি, কাটাকাটি, ঝগড়া করেছে। মানুষ তো নূন্যতম নালিশ দেয় সেটাও কখনো আসেনি।

বড় ছেলে রুমি আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ও প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক। রুমি ব্যাচের প্রথম ছিল আর সেই হিসেবে সেখানেই চাকরি করছে। ছোট ছেলে রফিক কুয়েট থেকে পড়ালেখা শেষ করে চাকরির জন্য আবেদন করছে। ছেলেরা এসএসসি পাশ করেছে ফতুরøা পাইলট স্কুল থেকে আর এইচএসসি পাস করেছে সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বক্তব্যে যোগ করেন জয়নাল উদ্দিন। তিনি জানান, প্রশাসনের কাছ থেকে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় আমাকে ফোন করে। তারা আমার তথ্য নেয়। তাদের আমি বলেছি, সুষ্ঠু তদন্ত করে। তাদের অন্যায় ভাবে যেন না ফাঁসানো হয়। এখন যে ঘটনা ঘটেছে সেটা সাজানো নাকি কেউ শক্রতার থেকে করেছে এটা আমার জানা নেই।

প্রতিবেশী লিটন আহমেদ বলেন, তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এটা শোনার পর থেকে এখনও পর্যন্ত বিশ্বাস হচ্ছে না। তারা অত্র এলাকায় সব থেকে শিক্ষিত ভদ্র ছেলে। পরিবারের সবাই শিক্ষিত। সরকারি চাকরি করে। এটা মেনে নেওয়ার মতো না। এলাকার মুদি দোকানদার লিটন মিয়া বলেন, আমার দোকান থেকেই বিভিন্ন সময় মুদি সদাই নেয়। তাদের কখনো কোন কিছু দেখি নাই যে সন্দেহ হবে। শিক্ষিত ভদ্র ছেলে। সে এসবে জড়িত না।
ওই এলাকার বাসিন্দা মুদি দোকানদার আলী আকবর জানান, প্রায় ৮ মাস পূর্বে বাড়িটিতে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্দেশ্যে ভাড়াটিয়া মোস্তফাকে অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়েছিল। তবে বাড়িটিতে বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। জনমানুষ শূণ্য টিনশেড বাড়িটিতে এরপর জনমানুষের আনাগোনা ছিলনা বললেই চলে।

মাঝেমধ্যে জয়নালউদ্দিন এসে দেখে যেতেন। তবে তার পুত্র রুমীকে প্রায়শই বাড়িতে আসতে দেখা যেত। তবে কখন আসতো আর কখন যেত সেটা আমরা জানতাম না। বাড়িটি যে জঙ্গী আস্তানাতে পরিণত হয়েছিল সেটা আমরা ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনি। ওই এলাকার বাসিন্দা বাবুল মিয়া জানান, জয়নাল আবেদীন সাহেবের দুই ছেলে অনেক ভদ্র ছিল। তারা যে বাড়িটিকে জঙ্গী আস্তানায় পরিণত করলে আমরা অন্তত টের পেতাম।
আলতাব হোসেন বলেন, এমন ভালো একটি পরিবারের ছেলে এর সঙ্গে জড়িত বলছে সেটা বিশ্বাস হয় না। তারপরও প্রশাসন বলছে এখানে বোম, কেমিকেল পাওয়া গেছে। তাই কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা নিজেদেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. আক্কাস আলী বলেন, এখানে বাড়ি করে বসবাস করতেন। প্রতিদিন সকালে গাড়িতে অফিসে যেতেন আবার গাড়িতে ফিরে আসতেন। তাই কখনো কথা হয়নি। তার সন্তানদেরও দেখা যেতো না। ১ থেকে ২ মাসে একবার তাদের দেখা যেতো। দুই ছেলে দুজনই শিক্ষিত। কারো সঙ্গে কখনো কোন খারাপ ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। সন্দেহ হওয়ার মতোও তেমন কোন কিছু দেখা যায়নি। কিন্তু সকালে জঙ্গি আস্তানে শুনে সবাই হতবাক। এরাকি আসলেই জঙ্গি।

জানা গেছে, রাজবাড়ি জেলার পাংশা এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম। চাকরি সূত্রে তিনি নারায়ণগঞ্জে ১৯৮১ সালে এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার দাপা ইদ্রাকপুর এলাকায় তার মালিকানাধীন একটি দোতলা বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। শিহারচর তক্কার মাঠ এলাকাতে জয়নাল আবেদীনের ৫ শতাংশ জমিতে দু’টি সেমিপাকা টিনসেড ভবন রয়েছে। প্রায় ৬ মাস পূর্বে এই সেমিপাকা টিনশেড ভবনের স্থলে বহুতল ভবন নির্মাণ হবে বলে মোস্তফাকে অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়।

এরপর থেকে এই সেমিপাকা ভবন দু’টিতে কেউ থাকতো না। তবে এখানে প্রায়শই জয়নালউদ্দিনের বড় ছেলে রুমির আসা যাওয়া ছিল বলে জানিয়েছেন আশেপাশের বাড়ির বাসিন্দারা। এই বাড়িটি তক্কার মাঠ চৌরাস্তার দক্ষিণ পূর্বে সড়কের পাশেই অবস্থিত ছিল। এই বাড়িটি থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ (পাগলা) পুরাতন সড়ক ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে খুব সহজেই যাওয়া যেত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here