প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ মুঃ আঃ মোতালিব, তালতলী (বরগুনা) থেকে॥রাখাইন নারী তাঁতীদের তৈরি করা শীতের বাহারী চাদর, শার্ট পিস, ব্যাগ, শাড়ি, লুঙ্গী, গামছাসহ প্রয়োজনীয় সব বস্ত্রের কদর দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্রই রয়েছে। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা বিভিন্ন রঙ বে-রঙয়ের সুতা দিয়ে হস্তচালিত তাঁতে তৈরী রাখাইনদের নান্দনিক কারুকাজ খচিত বস্ত্রের চাহিদা সারাবছর খুব বেশি না থাকলেও শীত মৌসুমে এর ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যায়।
তাইতো শীত মৌসুমকে সামনে রেখে বরগুনার তালতলী উপজেলার রাখাইন তাঁতীদের কাপড় বোনায় ব্যস্ততা বেড়ে গেছে।দীর্ঘদিনের এ মৌসুমী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গত কয়েক বছর ধরে প্রায় সারা বছরই কম-বেশি চালু থাকে বলে জানিয়েছেন রাখাইন নারী তাঁতীরা। কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, বরগুনার তালতলী উপজেলায় ৩০৭ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুত কেন্দ্র, শুভ সন্ধ্যা সী-বিচ, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প, সোনাকাটা ইকোপার্ক, পাথরঘাটার হরিণঘাটা, লালদিয়ার চরে পর্যটনস্পট।
এদিকে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় পায়রা সমুদ্র বন্দর, ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, নৌ ঘাঁটি, দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন, সাগরকন্যা কুয়াকাটার পর্যটন কেন্দ্রে বছরের বারোমাসই পর্যটকদের ভীড় থাকায় রাখাইনদের তৈরি বস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলার কালাচানপাড়া, গোড়াআমখোলাপাড়া, দিয়ার আমখোলা পাড়া, নয়াপাড়া, নাইউরী পাড়া, মংথয়পাড়া, থঞ্জুপাড়া, মিশ্রিপাড়া, লক্ষীপাড়া, বৌলতলীপাড়া, পক্ষীয়াপাড়া, কেরানীপাড়া এবং বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার তালতলীপাড়া, ছাতনপাড়া, গোড়াঠাকুরপাড়া, আগাঠাকুরপাড়া, মনুসেপাড়া, অংকোজানপাড়া, তাতেপাড়া, লাউপাড়া, নামেসেপাড়া, কবিরাজপাড়া, সওদাগাড়পাড়া ও তালুকদারপাড়ায় রাখাইনরা স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন।
চল্লিশ দশকের শেষভাগে এ অঞ্চলগুলোতে ২৪২টি রাখাইন পাড়া বা পল্লী ছিল। প্রবীণ রাখাইনরা জানিয়েছেন, সে সময়ে বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় ৬০ হাজারেরও বেশী রাখাইন নারী-পুরুষ বসবাস করতেন। বর্তমানে রাখাইন জনসংখ্যা ১০ হাজারেরও নিচে নেমে এসেছে।পাশাপাশি বহু রাখাইনপাড়া বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একসময়ে জায়গা জমি ধনদৌলতে খুবই স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ ছিল রাখাইনরা। তারা গড়ে তুলেছিলেন বড় বড় বৌদ্ধ বিহার (প্যাগোডা), শ্মশান (চে-শেই) ও শান বাঁধানো পুকুর। পালিত হতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ বৈশাখী পূর্ণিমা, চৈত্র সংক্রান্তি বা সাংগ্রান, নববর্ষ উৎযাপনে জলকেলী উৎসবসহ নানা অনুষ্ঠান।
শ্রমন, বিয়ে অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ, বৌদ্ধ বিহারাধ্যক্ষের মৃত্যু পরবর্তী শ্রাদ্ধ আড়ম্বর পরিবেশে পালিত হতো। নানাবিধ সমস্যায় তারা আর্থ সামাজিক প্রতিযোগিতায় হোচোট খেতে থাকে। যেকারণে এ অঞ্চল থেকে রাখাইন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে।বরগুনার তালতলী পাড়া, ছাতন পাড়া, মনুখে পাড়া, আগাঠাকুর পাড়া, নিশানবাড়ীয়া ইউনিয়নের সওদাগর পাড়া, তালুকদার পাড়া ও সোনাকাটা ইউনিয়নের কবিরাজ পাড়া, নামিষে পাড়া, লাউপাড়া ও অংকুজান পাড়াসহ রাখাইন পাড়াগুলোতে প্রায় শতাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। কোনো কোনো পাড়ায় একই পরিবারে দুই থেকে তিনটি তাঁতও রয়েছে।
কলাপাড়া, কুয়াকাটা ও গলাচিপায় রয়েছে আরও প্রায় দুই শতাধিক তাঁত। এসব তাঁতে প্রায় ছয়শ’র বেশী পেশাদার নারী তাঁতী কাপড় বুনন করে থাকেন।তালতলী উপজেলার মোমেসে পাড়ার মংচিন থান জানান, একসময়ে তাঁত বস্ত্রের উপরই নির্ভরশীল ছিল রাখাইন পরিবারগুলো। রাখাইন পরিবারের মধ্যে এমন প্রচলন ছিল যে, মেয়েরা হস্তচালিত তাঁত শিল্পের কাজ না জানলে তাদের বিয়ে হতোনা। রাখাইনদের তাঁতে প্রথমদিকে পরিবারের চাহিদা মেটাতে কাপড় বোনা হতো।
পরে তারা বাণিজ্যিক পরিসরে এ কাজ শুরু করলে দেশব্যাপী তাদের বস্ত্রের ব্যাপক কদর বাড়ে। কিন্তু যথার্থ পদ্ধতিতে বিপণন বা রপ্তানী করতে না পারায় তাদের এ শিল্প বেশীদূর যেতে পারেনি। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদৌলতে উপকূলে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ডে একদিকে যেমন বেড়েছে জনসমাগম, তেমনি বেড়েছে বিকিকিনি। তাছাড়া পদ্মা সেতু চালুর পর এখন আর ঢাকা থেকে দেশের সর্বদক্ষিণের জেলায় আসতে কোন ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হচ্ছেনা।
সম্পূর্ণ ফেরি বিহনীভাবে পর্যটকরা খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্রগুলো আসতে পারছেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নতির সাথেসাথে তাদের (রাখাইন) পন্যের প্রসার ঘটছে।রাখাইন নেত্রী এ্যামেন রাখাইন যুগান্তরকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসরত রাখাইন সম্প্রদায়ের লোক সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছিল। কর্মসংস্থানের অভাবই ছিল তার প্রধান কারণ। কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় এ অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।
তাই আমরা (রাখাইন) আমাদের হারানো ঐতিহ্য ও অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। তারই ধারাবাহিকতায় শীত মৌসুমকে সামনে রেখে রাখাইন পল্লীগুলোতে পোশাক তৈরির ধুম পরেছে। পরিবারের সবাই মিলে মনের মাধুরী দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বাহারি ডিজাইন ও নানা রঙের পোশাক। আর এসব পোশাক ক্রয় করতে ভিড় করছেন এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকরা।