প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ মুঃ আঃ মোতালিব, তালতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি॥ বঙ্গোপসাগরের উত্তাল হিংস্র ঢেউয়ের ছোবল আর ভাঙ্গনের ফলে সাগর উপকূলীয় টেংরাগিরি বনটি এখন বিলিনের পথে। গত ৬২ বছরে প্রায় আড়াইশো কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার একর জমিসহ কয়েক লক্ষাধিক গাছ সাগর গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।
সাগরের ভাঙন রোধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় ভবিষ্যতে বনটি টিকে থাকবে কিনা সে প্রশ্ন এখন সকলের মুখে মুখে। ইতোমধ্যে বনরক্ষায় জাইকার ২ সদস্য বিশিষ্ট একটি টিম টেংরাগিরি ফাতরার বন পরিদর্শন করেছে। পটুয়াখালী বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান সরকার ১৯৬০ সালে টেংরাগিরি বনটিকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে। কাগজে কলমে টেংরাগিরি বন হলেও স্থানীয় ভাবে বনটি ফাতরার বন হিসেবে নামে অধিক পরিচিত। ১৩ হাজার ৬শত ৪৭ দশমিক ০৩ একর আয়তনের বনটির পূর্বদিকে রয়েছে কুয়াকাটা, মহিপুর ও আন্দার মানিক নদী।
পশ্চিমে লালদিয়া, কুমির মারা, পায়রা ও বিষখালীর মোহনা। উত্তরে সোনাকাটা, নিশান বাড়িয়া ও সখিনা খাল। দক্ষিণে রয়েছে বিশাল বঙ্গোপসাগর। বনটির চতুর দিকে সাগর ও নদী বেষ্টিত এবং স্বাশ মূলীয় হওয়ায় পর্যকটদের কাছে এর আকর্ষন খুব বেশী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নির্বিচারে মানুষের গাছ নিধন ও সাগরের ঢেউয়ের ছোবলে বনের বির্যয়ের কারনে জৌলুশ হারিয়ে ফেলায় এখন আর আগের মত পর্যটকরা ফাতরার বনে আসে না। ১১ কিলোমিটার প্রস্থ্য আর ১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ টেংরাগিরি বনের পুরোটাই রয়েছে সাগরের তীর ঘেষে।
১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বনটি ২০২৩ সালে এসে মাত্র ৬১ বছরের ব্যবধানে বনের আকার কমে গেছে অনেক। ইতোমধ্যে প্রায় আড়াইশো কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার একর বন সাগর গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। ভেসে গেছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের বনের গেওয়া, কেওরা ধুন্দল, হেতাল রেন্ট্রিসহ বহু প্রজাতির গাছগাছালি। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম আসলে সাগরের হিংস্রতা বেড়ে যায়। এসময় পাহাড় সমান ঢেউ এসে বনের উপর আছরে পড়ে।
এভাবে অনাবরত ঢেউয়ের ছোবলে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে গাছের গোড়ার মাটি সরে গিয়ে গাছগুলো মাটিতে পড়ে সাগরে ভেসে যায়। এভাবে বছরে অন্তত কোটি টাকা মূল্যের গাছ ভেসে যাচ্ছে সাগরে। অন্যদিকে সাগরের ঢেউয়ে বনের ভিতরে বালু জমে শ্বাস মূল নষ্ট হওয়ায় অনেক গাছ মরে যাচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে,সাগরের তীর ঘেষে অবস্থিত ১৭ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বনের হাজার হাজার কেওড়া, গেওয়া, করমচা, হেতাল, রেন্ট্রি গাছ সাগরের ঢেউয়ের তোরে উপরে মাটিতে পড়ে আছে।
ভাটার সময় গাছ গুলো দেখা গেলেও জোয়ারের পরে এসে দেখা যাবে গাছ গুলো আর নেই সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এভাবেই দিনের পর দিন বছরের পর বছর ধরে গাছ যাচ্ছে সাগরের পেটে। সাগরের তীরের বালু পেড়িয়ে বনের ভিতরে ঢুকলেই দেখা যাবে ঢেউয়ের তোরে বনের ভিতরের প্রায় ৫শ মিটার পর্যন্ত গাছের গোড়ার মাটি সরে গেছে।
এ সকল গাছ এখন মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোন সময় বিলিন হয়ে সাগরের পেটে চলে যাবে। স্থানীয় ষাটোর্ধ বাসিন্দা লিয়াকত আলী জানান, সাগরের গভীরের ২মাইলের মধ্যে বাগান আছিল হেই বাগান সাগরে লইয়া গ্যাছে। ভাঙতে ভাঙতে বাগান এহন প্রায় শ্যাষ অইয়া যাওন ধরছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর বনদস্যুদের উৎপাতেও বনটির কাহিল দশা। ফকির হাটের স্থানীয় বাসিন্দা ছোলেমান হোসেন বলেন, ঘূর্নিঝড় বন্যাসহ নানা কারনে বনের কাহিল দশা।
প্রতি বছর বর্ষাকালে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের ছোবলে মাটি ক্ষয়ে গাছ উপরে পরে সাগরে ভেসে যাওয়ার কারনে বনের আকার ছোট হয়ে আসছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় বনটি বিলীন হয়ে যাবে সাগর গর্ভে। এছাড়াও রয়েছে বনদস্যুদের ছোবল। রাতে অন্ধকারে একশ্রেণির প্রভাবশালীদের ছত্রছায় দিনকে দিন বনের গাছ কেটে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে বনদস্যুরাআবু জাফর নামের এক জেলে জানান, একশ্রেণির বনদস্যু প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বনের গাছ কেটে নিচ্ছে বনদস্যুরা দিনের বেলায় গভীর জঙ্গলে গাছ কেটে ফেলে রাখেন রাতের বেলায় কাটা গাছ ট্রলার ভর্তি করে নিয়ে যান।
এসকল গাছ ইটভাটা এবং লাকরী হিসেবে বিক্রি করেন তারা। তিনি আরো বলেন, সাগরের তীর ঘেসে যে সকল গাছ রয়েছে তা ঢেউয়ের তোরে উপরে মাটিতে পরে আছে। বনদস্যরা এসকল গাছও নিয়ে যায়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে বনটি প্রায় লন্ড ভন্ড হয়ে যায়। সিডরে এ বনের কয়েক লক্ষ গাছ দুমরে মুছরে যায়। এ রেশ কাটতে না কাটতেই ২০০৯ সালে আবার আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। এতেও বনের অনেক ক্ষতি হয়। এরপর রয়েছে বনদস্যুদের উৎপাত।
স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একদল বনদস্যু দিনে রাতে সমান ভাবে বনের গাছ কেটে নদী পথে পাচার করছে উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন ইট ভাটাসহ স্বমিলে। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এই গাছ চুরির সাথে জড়িত। তারা দীর্ঘদিন ধরে ফাতরা, সুন্দরবন ও নলবুনিয়ার চর থেকে বিভিন্ন সময় গাছ চুরি করে থাকে। পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো.শফিকুর রহমান জানান, সাগরের ভাঙ্গনের হাত থেকে বনকে রক্ষার জন্য নতুন করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এছাড়া সাগরের ভাঙ্গনের হাত থেকে বনকে রক্ষার জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় এ বিষয়ে জুনের প্রথম সপ্তাহে জাইকার ২সদস্য বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী টিম বনএলাকা পরিদর্শন করেছে। তাছাড়া এবছর আমরা ঝাউগাছ এবং অন্যান্য প্রজাতির গাছ ঘন করে লাগাবো। যাতে সাগরের ঢেউ আছরে পরেm মাটির ক্ষয় করতে না পারে।