আজ ৩রা নভেম্বর গার্মেন্টস শ্রমিক অভ্যুত্থান

0

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর আনুমানিক ভোর ৫টায় নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরী প্যানটেক্স ড্রেস লিঃ এর শ্রমিকদের অবস্থান ধর্মঘটের সমাবেশে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হয় ঐ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক আমজাদ হোসেন কামাল এবং আহত হয় দুই শতাধিক শ্রমিক। আমি তখন ঐ প্রতিষ্ঠানের পাশে অন্য একটি কারখানায় রাতের শিফটে কর্মরত ছিলাম। গুলির শব্দ শুনে আমরা বিল্ডিং এর ছাদে গেলাম। তখনো আধো অন্ধকার। দেখলাম কয়েকটি গলিতে শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে।

এক পর্যায়ে বৃষ্টির মত গুলির শব্দে আতংকিত হলাম। সকালের শুরুতেই প্রথমে পাশের কারখানা এবং দুই এক ঘণ্টার মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সকল শিল্প এলাকার শ্রমিক রাস্তায় নেমে মিছিল শুরু করল। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম প্রতিটি এলাকায় শ্রমিকরা মিছিল করছে। তার মধ্যে আনুমানিক দুই লক্ষ শ্রমিক মিছিল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে চলে এসেছে। এই আন্দোলনের প্রধান নেতা এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইলকে ফতুল্লা থানায় আটক রাখার কারনে কয়েক হাজার শ্রমিক ফতুল্লা থানা ঘেরাও করেছে। সেখানে গুলি হচ্ছে।

কিন্তু শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করা যাচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে এক পর্যায়ে ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জ সদর থানার পুলিশ নিজেরাই থানা ছেড়ে নিরাপদে সরে যেতে বাধ্য হয়। পুলিশ যখন এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইলকে ছাড়ে তার পূর্বেই নারায়ণগঞ্জের সকল যানবাহন, দোকানপাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিস আদালত শতভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশ বিডিআরসহ সকল সরকারি বাহিনীকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুরু হল অঘোষিত হরতাল। এই হরতাল ছিল কয়েকদিন। জেলার সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান এক সপ্তাহ বন্ধ ছিল। ৩ নভেম্বর সকাল ১১টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জের প্রায় সকল শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দদের একটি মিটিং হয়েছিল।

সেখানে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি দাবীনামা দেওয়া হল। শ্রমিকদের ঐ দাবীর সাথে শ্রমিক লীগ, শ্রমিক দল, জাতীয় শ্রমিক পার্টি ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন একমত না হতে পারায় আমরা ১১ দলের (তৎকালীন) পক্ষ থেকে আন্দোলনে থাকলাম। ঐ সময়ে আমি (বিমল কান্তি দাস) ১১ দলের জেলা সমন্বয়ক থাকায় একেবারে ভিতর থেকে ঘটনাগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছি। পরবর্তিতে শ্রমিক লীগ, শ্রমিক দল, জাতীয় শ্রমিক পার্টি ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন প্রশাসনের সাথে যুক্ত হয়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। ৪ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রিয় ঈদগাহ মাঠে আমজাদ হোসেন কামালের জানাজা হবার কথা ছিল কিন্তু পুলিশ লাশ দিল না।

৪ নভেম্বর বিকেলে ১১ দলের কেন্দ্রিয় নেতৃবৃন্দ নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন এবং প্রশাসনের সাথে একটি বৈঠক হয়েছিল। ৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা ১১ দলের পক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টা হরতাল ডাকা হয়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত মিছিল এসেছিল। হরতালের সমাবেশে প্রায় এক লক্ষ শ্রমিক জমায়েত হয়েছিল। তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ১১ দলের সমন্বয়ক হিসেবে আমি (বিমল কান্তি দাস) ঐ সমাবেশে সভাপতিত্ব করি। ড. কামাল হোসেন বিমল বিশ্বাসসহ ১১ দলের কেন্দ্রিয় ও জেলা নেতৃবৃন্দ সমাবেশে বক্তব্য রেখেছিলেন।

আগেই উল্লেখ করেছি যে, ৫ নভেম্বর আমরা ১১দলের (তৎকালীন দল) পক্ষ থেকে শ্রমিকদের দাবির সমর্থনে নারায়ণগঞ্জে হরতাল ডেকেছিলাম। ঐ দিন খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে দুই নং রেলগেট এসে দেখি বিডিআর এর গাড়ি ঘন ঘন রাস্তায় টহল দিচ্ছে। তারা যাকেই দেখছে তাদের ভয় দেখিয়ে বলছে ‘তিন জন একসাথে দেখলে গুলির নির্দেশ আছে, রাস্তায় কেউ আসবেন না।’ ২ নং রেলগেটে বিডিআর গাড়ি থামিয়ে আমাকেও একই কথা বললো। অন্ধকার থাকতেই কিছুক্ষণ পর মন্টু ঘোষ আসলেন। বড় রাস্তাগুলো তখনো একেবারে ফাঁকা, বিডিআর এর গাড়িগুলো রাস্তায় বারে বারে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছে। কিছু সময় পর আমরা হরতালকারি নেতৃবৃন্দ মাত্র ৫/৭ জন জড়ো হয়ে রাস্তার পাশে এক গলির মাথায় দাঁড়িয়ে আছি।

তখনো আমাদের লোকজন এসে পৌঁছায়নি। অল্প সময়ের মধ্যে চারিদিক থেকে মিছিল আর শ্লোগানের আওয়াজ আসতে থাকলো। সাংগঠনিকভাবে কোন মিছিল আসার পরিকল্পনা আমাদের ছিল না, সাধারণ শ্রমিকরা নিজেরাই মিছিল করে আসছে। আমি, মন্টু ঘোষ ও আমাদের অল্প কয়েক জন দুই নং রেলগেট রাস্তায় মাঝখানে দাঁড়ালাম। সূর্যোদয়ের আগেই ঢেউয়ের মত একের পর এক মিছিল আসা শুরু করলো। এমন শ্লোগানের আওয়াজ জীবনে কখনো শুনিনি। মুহূর্তের মধ্যে প্রায় এক লাখ শ্রমিক চলে এসেছে, তার পরও মিছিল আসছে। বিডিআর এর গাড়ি আর শহরে কোথাও দেখিনা, পুলিশ তো ৩ নভেম্বর থেকে আর রাস্তায় আসে না।

এমন হরতাল দেখার সুযোগ জীবনে খুব বেশি পাওয়া যায়নি। সারা শহরে একটা রিকশা চলেনি, নদীতে নৌকা পর্যন্ত চলেনি। কাঁচা বাজারেও কোন মানুষ আসেনি। বড় বড় বাঁশের লাঠি ঘাড়ে করে হাজার হাজার শ্রমিক শুধু মিছিল নিয়ে আসছে। ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান আমি দেখিনি, মনে হল শ্রমিক শ্রেণির একটা অভ্যুত্থান চলছে। ড. কামাল হোসেন, বিমল বিশ্বাসসহ ১১দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ঢাকা থেকে এসে নারায়ণগঞ্জ ২ নং রেলগেট পৌঁছালেন। জেলার বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও তৎকালীন জেলা ১১দলের নেতৃবৃন্দ সমাবেশে উপস্থিত হলেন।

হরতালের মধ্যেই শ্রমিক সমাবেশ শুরু হলো। বাংলাদেশে বামপন্থীদের কোন সমাবেশে এমন লাখ লাখ মানুষ হতে পারে তা আমার বিবেচনায় ছিল না। এমন হরতালও ইতিপূর্বে আমার দেখা ছিল না। শ্রমিকশ্রেণি ঐক্যবদ্ধ রাস্তায় নামলে দেশের কি চেহারা হতে পারে তা অনুভব করলাম। ৫ নভেম্বর আমাদের হরতাল কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়। পর দিন ৬ তারিখ আমাদের হরতাল বা ধর্মঘটের ডাক ছিল না, কিন্তু অঘোষিত হরতাল চলতেই থাকলো। কার্যত ৩ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অঘোষিত হরতাল/ধর্মঘট অব্যাহত থেকেছে এবং অচল থেকেছে নারায়ণগঞ্জের সকল কার্যক্রম।

কোন কর্মসূচি ছাড়াই প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ জেলার সকল শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের বিক্ষোভ অব্যাহত থেকেছে। বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মিছিল ও ছোট ছোট সমাবেশ হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তৎকালীন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক ৩ নভেম্বর থেকেই আমাদের ১১দলের নারায়ণগঞ্জ জেলা নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে পরিদর্শন করতে থাকেন। কমরেড মন্টু ঘোষ, শফিউদ্দিন আহমেদ, বিমল কান্তি দাস, আবু নাঈম খান বিপ্লবসহ ১১ দলের নেতৃবৃন্দকে প্রতিদিন একবার বৈঠকে ডাকতে থাকলেন জেলা প্রশাসক। ২০০৩ সালে দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল বিএনপি সরকার। তখন গিয়াস উদ্দিন ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি।

তিনিও প্রায় প্রতিদিন আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন, মিটিং করেছেন। শ্রমিকদের দাবিনামার প্রশ্নে ঘন ঘন ত্রিপক্ষিয় মিটিং হতে থাকলো। এমপি গিয়াস উদ্দিন সকল মিটিংয়ে থাকতেন। সরকারি দল বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের ওপর হামলা আসতে থাকলো। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী যুবদলের ডেভিড গ্রুপ বারে বারে হামলা করেছে। নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের হলরুমে ত্রিপাক্ষিয় আলোচনা চলছে, হটাৎ যুবদল নেতা ডেভিড এসে এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইলের ওপর হামলা করলো, তাকে তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলো। চাষাড়া শহীদ মিনারে শ্রমিক সমাবেশ চলছে, সেই ডেভিড আবার হামলার চেষ্টা করলো।

রাতের বেলা দলবল নিয়ে নেতৃবৃন্দের বাসায় বাসায় খোঁজ করেছে ধরে নিয়ে যাবার জন্য। আমরা অনেকেই দীর্ঘদিন রাতে বাসায় থাকতে পারিনি। আমাদের নেতৃবৃন্দের নামে ১২টি মামলা দেয়া হলো। আমি নিজে দুই মাস চাকরি স্থলে যেতে পারিনি, রাতে বাসায় থাকতে পারিনি। শ্রমিকদের সমর্থন আমাদের সাহস যুগিয়েছে। যারা পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছিল তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিপদের মধ্যে দিন কাঁটিয়েছেন। ইতিমধ্যে ৪ নভেম্বর থেকে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, টংগী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আমজাদ হোসেন কামাল হত্যার বিচার চেয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকরা কারখানা বন্ধ করে রাস্তায় নেমেছে।

দেশের বাইরেও পৃথিবীর অনেক দেশে এ আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দিয়ে শ্রমিকদের মিছিল ও বিক্ষোভ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বড় বড় প্রচার মাধ্যমগুলো প্রতিদিন ছবি দিয়ে নারায়ণগঞ্জের সংবাদ পরিবেশন করছে। ২০০৩ সালের ৪, ৫ ও ৬ নভেম্বর সকল টেলিভিশন ও জাতীয় পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম ছিল এই আন্দোলন। রাশেদ খান মেনন, মনজুরুল আহসান খান, হায়দার আকবর খান রনো, বদরুদ্দিন ওমরসহ ২০ জন জাতীয় নেতা পত্রিকায় এ প্রসঙ্গে উপ-সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। এ আন্দোলন প্রসঙ্গে আমাদের দুইটি বই বেরিয়েছিল। তাঁর একটি প্রকাশ করেছিলো সমাজ অনুশীলন কেন্দ্র এবং অন্যটি প্রকাশ করেছিলো এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইল।

আন্তর্জাতিক প্রধান প্রধান প্রচার মাধ্যমগুলো কয়েকদিন যাবৎ এই আন্দোলনের সংবাদ প্রচার করেছিল। ১১ দলের ব্যনারে এই আন্দোলনের শীর্ষবিন্দুতে ছিলেন এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইল। এছাড়াও নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন এড. মন্টু ঘোষ, শফিউদ্দিন আহমেদ, আবু নাঈম খান বিপ্লব, বিমল কান্তি দাস, আব্দুল হাই শরীফসহ বাসদ সিপিবি ও ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা নেতৃবৃন্দ। একটানা দেড় মাস আন্দোলনের মাথায় মালিক পক্ষের সাথে শ্রমিক পক্ষের একটি চুক্তি হয়। মালিক পক্ষ সে চুক্তি আজও বাস্তবায়ন করে নাই। আমজাদ হোসেন কামাল হত্যার বিচার হবার কথা ছিল তাও হয় নাই।

২০০৩ সালে ৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের এই গার্মেন্ট শ্রমিক অভ্যুত্থান নিয়ে নানান মতামত শুনতে হয়েছে। আন্দোলনের শুরুতেই বর্তমান গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি ভাইদের পক্ষ থেকে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র ছাড়া হয়েছিল। তাদের অভিযোগ ছিল আমরা এ আন্দোলনকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে যাচ্ছি কেন? তারা বলতেন এ আন্দোলন তো বিপ্লবের দিকে নিয়ে যেতে হবে। উনারা আমাদেরকে শ্রমিক স্বার্থবিরোধী বলে অভিযোগ করেছিলেন। শ্রমিকদের পক্ষে দাবিনামা দেওয়ার জন্য আমাদের দালাল বলে অভিযোগ করেছিলেন।

অন্যদিকে বামপন্থী কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক নেতা এই আন্দোলনকে হটকারী ও নৈরাজ্যবাদী বলে আমাদের সমালোচনা করেছিলেন। কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন যে গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন করা ঠিক না। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয়েছে তাই এ আন্দোলনকে শ্রমআইন বিরোধী ও নৈরাজ্যবাদী এমন কি অগণতান্ত্রিকও বলেছিলেন। বলেছিলেন এটা অতি বামদের হটকারী কর্মকান্ড। আরও বলেছিলেন, গার্মেন্ট কোন শিল্প হতে পারবে না, এটা এক ধরনের দর্জিগিরি। যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, এটা শিল্প হিসেবে টিকবে না।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের তারা শ্রমিক বলেই মেনে নিতে পারেননি। এ শিল্পের বিকাশে তারা গার্মেন্ট মালিকদের সহযোগিতা করতে পরামর্শ দিতেন। ৩ নভেম্বরের আন্দোলন ছাড়াও গার্মেন্ট শ্রমিকদের অন্যান্য আন্দোলনকেও তারা হটকারী ও শ্রমআইন বিরোধী বলতেন। সেই অভিজ্ঞ শ্রমিক নেতাদের কথা তো একটাও খাটলো না; গার্মেন্ট থেকে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা (৭৭ শতাংশ) আসে, শ্রমিক আন্দোলনে গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলন এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ, বিএনপির, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে স্থানীয়ভাবে প্রচার করা হয়েছিল চীন ও ভারতের টাকা খেয়ে আমরা বাংলাদেশে থেকে গার্মেন্ট উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করছি।

আমাদের আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য তারা সভা সমাবেশ মিছিল কম করেনি। এতকিছুর পরও তখনকার সে আন্দোলনে শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করতে পারেনি, ঐক্য নষ্ট করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত গার্মেন্ট মালিক পক্ষ শ্রমিকদের দাবিনামা মেনে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি ঠিকই, কিন্তু সে আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের আর্থিক ও আইনগত অনেক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জের এই শ্রমিক অভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রথম বড় ধরনের কোন বিদ্রোহ। এর আগেও গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন হয়েছে। তবে এত বড় আকারে হয়নি।

২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত যারা ঐ সময়ে নারায়ণগঞ্জে উপস্থিত ছিলেন তাদের নিশ্চয়ই সেই ঘটনাগুলো স্মরণে থাকবে। এ প্রসঙ্গে আমরা যে দুটি বই প্রকাশ করেছিলাম, তাতে এই শ্রমিক অভ্যুত্থানের বিস্তারিত বর্ণনা আপনারা দেখতে পাবেন। বই দুটি পরবর্তী প্রজন্মের হয়তো কাজে লাগবে। কিন্তু সে আন্দোলনের বর্ণনা দেওয়া এ লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। যে বাস্তব পরিস্থিতির কারণে ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের বিসিক শিল্প এলাকায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের অভ্যুত্থান ঘটেছিল বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তেমন একটি বাস্তবতা বিরাজ করছে।

সরকারি শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন বহু আগেই দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি শ্রমিকদের এক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়েছে। একের পর এক শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কালো আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, মালিক শ্রেণির পক্ষে আইন সংশোধন করা হয়েছে। তাতে শ্রমিকরা ভিতরে ভিতরে বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে। অল্প মজুরি, মালিক পক্ষের অতিরিক্ত কাজের চাপ আর খারাপ আচরণ শ্রমিকদের মানসিক যন্ত্রনা বৃদ্ধি করছে। গুন্ডা, মাস্তান, ভয়ভীতি, হামলা, মামলা, ছাঁটাই নির্যাতন প্রতিমুহূর্তে শ্রমিকদের মানসিকভাবে বিক্ষুব্দ করে তুলছে। কথা বলার অধিকার, সংগঠন করার অধিকার, সভা সমাবেশের অধিকার একেবারে সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে।

উন্নত প্রযুক্তি ও উন্নত মেশিনারীজের কারনে ব্যাপকহারে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, শ্রমিকদের রুটি-রুজি, জীবন-জীবিকা এক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিপতিত হচ্ছে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার কার্যত নেই, গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। তাদের মানসিক যন্ত্রণা ও ক্ষোভ দৃশ্যত চোখে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ক্রমাগত পুঞ্জিভ‚ত হচ্ছে। যেহেতু শ্রমিকদের জন্য কার্যত গণতন্ত্র নেই ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকান্ডের সুযোগ নেই, তাই পুঞ্জিভূত এই ক্ষোভের কারণে বিক্ষোভ বিস্ফোরণ আকারে হটাৎ যেকোন সময় ঘটতে পারে। আবারও ফিরে আসতে পারে ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর। হয়তো আরও একটু বড় আকারেও আসতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here