প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ তালতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি॥ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর
বরগুনার তালতলী উপজেলার পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের চন্দনতলা গ্রামের ১৩ টি হিন্দু পরিবারের অর্ধশতাধিক সদস্যরা আতঙ্কে তাদের পৈত্রিক ভিটা-মাটি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
নতুন করে এসব হিন্দু পরিবারের ওপর কোন হামলার ঘটনা না ঘটলেও ১০ বছর আগে এসব পরিবারের ওপর ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে আতঙ্কগ্রস্থ হয়েই তারা এলাকা ছেড়েছেন। ওই গ্রামে স্থাপিত পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরাও চলে যাওয়ায় তাদের আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। ৮ আগস্ট হিন্দু পরিবারগুলো তাদের ঘরবাড়ি তালাবদ্ধ করে অন্যত্র চলে যাওয়ার পর থেকে স্থানীয় ছোটবগী হাফেজিয়া মাদ্রাসার ২ জন শিক্ষক ও ১৭ জন শিক্ষার্থী পুলিশ ফাঁড়িতে অবস্থান করে কিছুদিন পাহাড়া দেওয়ার পর তারাও এখন চলে গেছে।
জানা গেছে, বরগুনার তালতলী উপজেলার পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের চন্দনতলা গ্রামে দেশস্বাধীনের পূর্ব থেকে ১৩টি হিন্দু পরিবার বসবাস করে আসছে। তাদেরব সতভিটাসহ ৪০ একর জমি রয়েছে। ওই জমির উপর লোলুপ দৃষ্টি পরে ওই গ্রামের প্রভাবশালী আবদুর রশিদ আকনের। তাদের জমি এবং বসতভিটা দখলে নিতে হিন্দু পরিবারের উপর নানাভাবে নির্যাতন চালিয়ে আসছিলেন আ. রশিদ আকন। ২০১৪ সালের শেষের দিকে ওই হিন্দু পরিবারের মধ্যে যাদব চন্দ্রের স্কুলপড়ুয়া কন্যাকে উত্ত্যক্ত করতেন তিনি। পরে বরগুনা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে রশিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন যাদব।
ওই মামলায় কিছু দিন কারাভোগের পর জামিনে বেড়িয়ে আসেন রশিদ। ওই মামলায় বিচার পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো তাদের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার শুরু করেন রশিদ। অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পৈত্রিক ভিটা-মাটি ফেলে রেখে ২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বর এলাকা ছেড়ে বরগুনাসহ বিভিন্ন স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন পরিবারগুলো।
এ ঘটনায় রশিদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের হলে রশিদকে গ্রেপ্তারকরে পুলিশ। তৎকালীন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, বরগুনা পুলিশ সুপার, বরগুনা জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আবার হিন্দু পরিবারগুলো তাদের ভিটেমাটিতে ফিরে আসেন। এসব হিন্দু পরিবারের নিরাপত্তার জন্য এখানে স্থাপন করা হয় একটি পুলিশ ফাঁড়ি। পরে ১০ বছর ধরে তাঁদের ভিটামাটিতে বসবাস করে আসলেও গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের দুই দিন আগে ওই ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা সকলেই বরগুনায় চলে যায়। ওই সুযোগে জামিনে আসা সেই রশিদ আকনও ওই হিন্দু পল্লীতে আসেন।
তাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে ৮ আগষ্ট ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় ১৩টি হিন্দু পরিবার। পৈত্রিক ভিটা-মাটি ছেড়ে যাওয়া পরিবারগুলো হচ্ছে- যাদব সরকার, হরেন রায়, মাধব সরকার, সুভাষ চন্দ্র, রমেশ চন্দ্র, কমল চন্দ্র, শ্যামল হাওলাদার, রনজিত কুমার, বিমল চন্দ্র, রিপন রায়, সমীর সরকার, প্রশান্ত সরকার ও রিমল রায়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিবেশী বলেন, রশিদ এলাকায় আসার পর আতঙ্কে হিন্দু পরিবার গুলো এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। এর ১০ বছর আগেও এই রশীদের নির্যাতনে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল ওই হিন্দুরা।
এখন তাদের ঘরবাড়ি ফাঁকা অবস্থায় পরে আছে।বগিরহাট হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ মো. আশিকুর রহমান বলেন, ৮ আগষ্ট বিকালে ১৭ জন ছাত্র নিয়ে এই পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে থেকে কয়েকদিন ধরে হিন্দু পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল রক্ষার জন্য পাহাড়া দিয়েছি। তালতলী পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রতন কুমার বিশ্বাস বলেন, আমি ওই পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি তারা ভয়ে আত্নীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।এসব হিন্দু পরিবারের প্রধান যাদব চন্দ্র বর্তমানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন। মোবাইলে কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, আমাদের নির্যাতনকারী প্রভাবশালী নামধারী বিএনপি নেতা রশিদ আকন এলাকায় ফিরে এসেছে। তাকে আমরা ভয় পাই, কারন সে আমাদের অনেক নারী শিশুকে নির্যাতন করেছে। এর মধ্যে সরকার পতনের পর চন্দনতলা পুলিশ ফাড়ির সদস্যরাও তাদের নিরাপত্তাহীনতার কারনে চলে গেছে। এখন আমরা এখানে থাকি কি করে।
তাই সবাই আমরা আত্বীয় স্বজনদের বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় নিয়েছি। যত দিন ফাড়ির পুলিশ সদস্যরা না আসবে ততদিন আমাদের মেরে ফেললেও আমরা বাড়িতে ফিরে যাবো না। আব্দুর রশিদ আকন মোবাইলে জানান, আমি কাউকে হুমকি দেইনি। উপরন্ত যাদবসহ হিন্দু পরিবারগুলোকে আমি এলাকা ছেড়ে না যাবার জন্য অনুরোধ করেছি। তারা আমার কথা শুনেনি।পচাঁকোড়ালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারনে হিন্দু পরিবারগুলো তাদের বাড়িঘর ছেলে পালিয়ে গেছে। কারন এখানে একটি পুলিশ ফাড়ি ছিল।
সরকার পতনের পর ফাড়ির পুলিশ চলে যাওয়ায় হিন্দু পবিারগুলো রশিদের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আমি তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ছিলাম কিন্তু ভয়ে তারা আসতে চায় না। তালতলী উপজেলা বিএনপির আহবায়ক মো. শহীদুল হক বলেন, রশীদ আকন আমাদের দলের কেউ নয়। তাকে আমি কোন দিন দেখি নাই এবং চিনি না। তিনি আরো বলেন, রশিদ আকন একজন খারাপ লোক তার বিচার করা হোক।তালতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, নিরাপত্তার আশ^াস দিয়ে আমরা হিন্দু পরিবারগুলোকে তাদের বাড়ি-ঘরে ফিরিয়ে এনেছিলাম পরে তারা আবার চলে গেছে।
আমরা
তাদের সার্বিক নিরাপত্তায় আন্তরিকভাবে কাজ করছি। তিনি আরও বলেন, রশিদ আকনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতনসহ একাধিক মামলা রয়েছে। ইতোপূর্বে একটি মামলায় সে কারা ভোগও করেছে। তালতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিফাত আনোয়ার তুমপা বলেন, ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পর থেকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু ফাড়িতে পুলিশ না থাকার অজুহাত দিয়ে হিন্দু পরিবারগুলো অন্যত্র চলে গেছে।
আমরা এসব পরিবারকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। বরগুনার অতিরিক্ত পুুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেন,নিরাপত্তাহীনতার কারনে পুলিশ কর্মবিরতিতে গেলে ওই ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরাও চলে আসে। সারা দেশে এ ধরনের অস্থায়ী ফাঁড়ি থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত হলেই আবার ওই ফাঁড়িতে পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হবে।