রাগন চাষে ব্যবহার হচ্ছে ‘টনিক’ স্বাস্থ্য ঝুঁকি কতটা ?

0
রাগন চাষে ব্যবহার হচ্ছে ‘টনিক’ স্বাস্থ্য ঝুঁকি কতটা ?

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ গত কয়েক বছর ধরে ড্রাগন ফল বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর বিদেশি এই ফলটি এখন বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। দেশের কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ড্রাগন ফলের আলাদা চারটি প্রজাতিও উদ্ভাবন করেছেন। এগুলো হচ্ছে বারি-১ যা কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট উদ্ভাবন করেছে।

এছাড়া কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ ও জার্মপ্লাজম সেন্টার মিলিতভাবে তিন প্রজাতির ড্রাগন ফল উদ্ভাবন করেছে। এগুলো হচ্ছে বাউ ড্রাগন-১, বাউ ড্রাগন-২ এবং বাউ ড্রাগন-৩। দেশীয় ভাবে উৎপাদন বাড়ার কারণে দামও কমে এসেছে এক সময়ের দামী এই ফলটির।তবে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘টনিক’ ব্যবহার করে উৎপাদিত ড্রাগন ফল এবং এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, এসব ফল থেকে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। কিন্তু ড্রাগন চাষে কি আসলেই ‘টনিক’ ব্যবহৃত হচ্ছে? আর ব্যবহৃত হলে এসব ড্রাগন ফল খেলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা কতটা রয়েছে?

 ‘টনিক’ ব্যবহৃত হচ্ছে?
নাটোর ড্রাগন ফ্রুটস এর পরিচালক মনিরুজ্জামান মুন্না। বছরে প্রায় ৫০-৬০ টনের মতো ড্রাগন ফল উৎপাদন করে থাকেন তিনি। ১০ বছর আগে ২০১৪ সালে ইউটিউব দেখে ড্রাগন ফল গাছের চারা সংগ্রহ করে নাটোরে বাগান গড়ে তোলেন তিনি। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, একবার ড্রাগন ফলের বাগান করলে এবং সেটি সঠিকভাবে চাষাবাদ করা হলে প্রায় এক শতাব্দী ধরে ফল পাওয়া সম্ভব।
যে ডালটা পুরাতন হয়ে যাবে ওই ডালটা কেটে দিলে উপর দিয়ে নতুন ডাল বের হয়। এভাবে রি-শাফল করে যদি কেউ কাটে সেক্ষেত্রে গাছ যতদিন চান ততদিন রাখতে পারবে।” জুনের পর থেকে বছরের বাকি সময় ড্রাগন ফলের বেশ ভাল দাম পাওয়া যায় বলেও জানান তিনি।টনিক ব্যবহারের বিষয়ে মুন্না বিবিসি বাংলাকে বলেন, টনিক ব্যবহার করে ড্রাগন ফল চাষ করেন এমন কয়েক জন চাষির সাথে পরিচয় রয়েছে তার। আর তাদের সাথে আলাপ করেই নিজের বাগানে টনিক ব্যবহার করেন না তিনি।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যে চাষিরা ব্যবহার করেছে তাদের কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন, এই টনিক ব্যবহার করলে প্রথমে এক-দুই বছর ভালো ফলন পাওয়া গেলেও পরে ফলন কমে যায়। এছাড়া গাছও দুর্বল হয়ে পড়ায় সার ও খাবার বেশি দিতে হয়।একই সাথে বড় ড্রাগন ফলের তুলনায় ছোট ড্রাগন ফলে ভাল দাম পাওয়া যায় বলেও জানান মুন্না। তিনি বলেন, “এই টনিক সম্ভবত ভারত থেকে আসে। চুয়াডাঙ্গা, কালীগঞ্জের দিকে এই টনিক বেশি ব্যবহার হয়।
কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের ফল বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. উবায়দুল্লাহ কায়ছার বলেন, সম্প্রতি ড্রাগন চাষে এই টনিক ব্যবহারের বিষয়টি জানতে পেরেছেন তারা। সীমান্ত এলাকার কিছু কৃষক এই টনিক ব্যবহার করছে। তিনি জানান,এরইমধ্যে এই ড্রাগন ফল এবং যে টনিক ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর নমুনা সংগ্রহ করেছেন তারা। এগুলোর রাসায়নিক পরীক্ষা করে দেখা হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ড্রাগন চেনার উপায়, ।’টনিক কী?কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের ফল বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. উবায়দুল্লাহ কায়ছার বলেন, টনিকটা হচ্ছে এক ধরণের হরমোন। এটা গাছে ব্যবহার করলে তার বৃদ্ধি বেশি ও দ্রুত হয়।
এই পদ্ধতির ব্যবহার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট উৎসাহিত করে না।তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের গবেষণার রিকমেন্ডেড না।এটা বাহির থেকে একটা হরমোন আসছে। এটা আমাদের সরকারিভাবেও অনুমোদিত না বাউ ড্রাগন প্রজাতিটি উদ্ভাবনের সাথে জড়িত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক ড. মো. মোক্তার হোসেন। তিনি বলেন, গাছ ও ফলের বৃদ্ধি তরান্বিত করতে বিভিন্ন ধরণের হরমোন রয়েছে। ড্রাগন ফল উৎপাদনের জন্য যে টনিক ব্যবহার করা হচ্ছে তার নাম হচ্ছে জিএ৩ বা জিবারেলিক এসিড থ্রি। এটি মূলত এক ধরণের হরমোন। তবে এটি টনিক নামেই ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে।তিনি জানান,এটি মূলত গ্রোথ হরমোন। তবে টনিক হিসেবে যেটি ব্যবহার করা হয় সেটিতে হরমোন ছাড়াও এর সাথে আরো কিছু উপাদানও মিশ্রিত করা হয়।
এগুলো খুব র‍্যাপিড এক্সপ্যানশন করে ফ্রুটসের। অনেকগুলো বাগানেই এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।বাউবি থেকে যেসব কৃষকদের চারা প্রদান করা হয়, তাদেরকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতেই ড্রাগন উৎপাদনের পরামর্শ দেয়া হয়। তিনি বলেনআমরা তাদেরকে বলি ন্যাচরাল প্রডাকশনে থাকলেই ড্রাগনের ফিউচারটা ব্রাইট হবে। আর কোন কারণে কেমিকেল ইউজ করা হলে কাস্টমাররা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তখন বেশি প্রোডাকশন করেও পারবেন না।বাংলাদেশে শুধু ড্রাগন ফল নয় বরং মূলা উৎপাদনেও এই টনিক ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এতে মূলার উৎপাদনের সময় অন্তত ২০ দিনের মতো এগিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। মূলা উৎপাদনে সাধারণত ৬০-৬৫ দিনের মতো সময় লাগে।অধ্যাপক ড. মো. মোক্তার হোসেন বলেন, টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ড্রাগন ফল দেখে চেনার কিছু উপায় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- সাধারণ ও প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত ড্রাগন ফলের ওজন আড়াইশ থেকে সর্বোচ্চ তিনশ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ড্রাগন ফলের ওজন ৩০০ গ্রাম থেকে শুরু করে ৯০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ফলের বাহ্যিক আকার উদ্ভট হয়ে যায়।এই ড্রাগন ফলের রং পার্পেল বা লাল রঙ হয় থাকে না।
সহজ করে বলতে গেলে, পুরো ফলটি আর এক রঙা থাকে না। পার্পেল বা লাল রঙের সাথে সবুজ রঙের মিশ্রণ থাকে। এক পাশে বা অন্তত এক তৃতীয়াংশ সবুজ থাকে। কারণ পুরো এক রঙের হওয়া পর্যন্ত গাছে রাখা হলে সেটি পঁচে যায়। আর এক সাথে চার-পাঁচদিনের মধ্যে বিক্রি না হলে পুরোটাই হলুদ রঙের হয়ে যাবে।টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ড্রাগন ফল হবে পানসে। মিষ্টি একেবারেই হবে না। এছাড়া স্বাদেও বেশ ভিন্ন হবে।অধ্যাপক মোক্তার হোসেন বলেন, ‘যখন আপনি টনিক ব্যবহার করছেন, তখন গ্রোথ(ফলের বৃদ্ধি) খুব র‍্যাপিডলি(দ্রুত) হচ্ছে। বাহ্যিক আকারও তখন স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন হবে। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান তৈরি হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাচ্ছে না।
এর আগেই সেগুলো তুলে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে কারণ সেগুলো বেশি দিন থাকলে ওয়েট(ওজন) অনেক বেড়ে যায়।স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আছে কি? অধ্যাপক ড. মো. মোক্তার হোসেন বলেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত যেকোন পণ্যেরই স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন রাসায়নিক নিরাপদ উপায়ে ব্যবহারের মাত্রা ঠিক করে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা মানা হয় না। বেশি পরিমাণে হরমোন বা রাসায়নিক ব্যবহার করা হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
তবে এই হরমোন ব্যবহারের কোন সহনীয় মাত্রা আছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হরমোন ব্যবহারেরই কোন অনুমোদন বাংলাদেশে নেই।কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটরে ফল বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. উবায়দুল্লাহ কায়ছার বলেন, এই টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ফলের স্বাস্থ্য ঝুঁকি খাকতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এই হরমোন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করা হলে এর একটা স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। আর এ কারণেই তারা এটি পরীক্ষা করে দেখার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here