একাত্তরের ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত

0
একাত্তরের ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত

প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ খান মোহাম্মদ কামালঃ  খান মোহাম্মদ কামালঃ বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে দেশকে স্বাধীন করার মরণপণ শপথ অন্তরে ধারণ করে প্রককম্পিত করে তুলেছিল গোটা ঢাকা শহরকে, বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিল এই বার্তা—সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। সেদিনের সেই টগবগে তরুণদের অনেকেরই শ্মশ্রু-গুম্ফ শ্বেতবর্ণ ধারণ করেছে; কপালে এবং চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে কারও কারও।

কিন্তু স্ত্রী-পুত্র, নাতি-নাতনি নিয়ে তারা যখন এই মিলনমেলায় সমবেত হলেন, কে বলবে তারা বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন! অন্তরে বিজয়ের গর্ব, চোখেমুখে খুশির ঝিলিক, যেন সবাই সেই একাত্তরের তরুণ, চিরকালের নওজোয়ান। হ্যাঁ ঢাকা শহরে গেরিলা যুদ্ধের সেই ক্র্যাক প্লাটুনের কথাই বলা হচ্ছে। অপারেশন, অ্যাকশন, দুঃসাহস ও আত্মত্যাগের ঘটনা যাদের করেছে কিংবদন্তি।শনিবার (৪ মার্চ) রাজধানীর পূর্বাচলে এই দুর্র্ধর্ষ গেরিলা গ্রুপের পূনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। দিনব্যাপী এই পূনর্মিলনী অনুষ্ঠানে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের স্ত্রী-পুত্র,নাতি-নাতনি মিলে শতাধিক লোকের সমাগম ঘটে।

এই দুর্র্ধষ গেরিলা গ্রুপের নেতৃত্ব দেয়া মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, ৭১ সালে ঢাকা শহরের মূল অপারেশনগুলো এই ক্র্যাক প্লাটুনের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। ঢাকা শহরের বুকে প্রথম ও শেষ অপারেশনও এই প্লাটুনের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফে এর নির্দেশনা ছিলো হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে বিদেশী সাংবাদিক ও অতিথিরা থাকাকালীন ঢাকা শহরের পরিস্থিতি যে শান্ত নয় এবং এখানে যুদ্ধ চলছে তা বোঝানোর জন্য শহরের আশে-পাশে কিছু গ্রেনেড ও গুলি ছুড়তে হবে।

কিন্তু আমরা ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করি যা ছিলো অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ ও অচিন্তনীয় কাজ। সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বলেন, ‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে আর ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে।’ তিনিই প্রথম এই দলটিকে “ক্র্যাক” আখ্যা দেন; যা থেকে পরবর্তীতে এই প্লাটুনটি “ক্র্যাক প্লাটুন” নামে পরিচিত হয়। আরও কয়েকটি গ্রুপ এখানে সক্রিয় ছিল। কিন্তু ক্র্যাক প্লাটুনের মতো এত খেতাব আর কোনো গ্রুপ অর্জন করতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনগুলো সফলভাবে পরিচালনার কারণেই ক্র্যাক প্লাটুনের এত সুনাম এত খেতাব।

এ প্রসঙ্গে অতি দুঃসাহসিক হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশনের কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। শুধু অপারেশনই নয়, অপারেশনের পর মাথা সুস্থির রেখে তাৎক্ষণিক সেই ধ্বংসকাণ্ডের ছবি তুলে নিয়েছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা দুলাল। এই একটি ঘটনাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। গোটা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে এ ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল, দুর্র্ধষ গেরিলা যোদ্ধারা ঢাকার কেন্দ্র্রস্থলে সফল অপারেশন চালিয়ে জান্তা ইয়াহিয়া এবং তার হানাদার বাহিনীর শক্তভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে।

ঢাকা শহরের পাওয়ার হাউসগুলোতে পরিচালিত সফল অপারেশনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন তড়িৎ প্রকৌশলী শহীদ নজরুল ইসলামকে। মূলত তিনিই ছিলেন পাওয়ার হাউস অপারেশনের মূল পরিকল্পনাকারী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঢাকা শহরের সমস্ত অপারেশন ও অ্যাকশনে সেক্টর-২ এর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) ও ক্যাপ্টেন হায়দার (পরবর্তীতে ব্রিগিডিয়ার) এর ভূমিকার কথা তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেন। তাদের তত্ত্বাবধান, অনুপ্রেরণা, যুদ্ধের কলাকৌশল নিবিড়ভাবে প্রক্ষিণদান ব্যতিরেকে এত সফল অভিযান কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না। এ ছাড়া ঢাকা শহরের চারটি পরিবারের কথাও তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।

এগুলো হচ্ছে হাবিবুল আলমদের পরিবার, তড়িৎ প্রকৌশলী শহীদ নজরুল ইসলামের পরিবার, মোহন-দুলালদের পরিবার, পুরান ঢাকার ছক্কা-ফক্কাদের পরিবার। এই বাড়িগুলো ছিল ঢাকা শহরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার এক একটি দুর্জয় ঘাঁটি। থাকা-খাওয়া, বিশ্রাম,প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও অস্ত্র সংরক্ষণের জন্য এই বাড়িগুলো পরম নির্ভরতার সঙ্গে ব্যবহৃত হতো। মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারগুলোর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।  মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ‘সব শেষে ফল অব ঢাকা’ অর্থাৎ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকা পুনরুদ্ধারের কথা।

সেদিনের ঘটনা কখনোই ভুলব না। মেজর হায়দার এর নেতৃত্বে আমরা অ্যাডভান্স পার্টি হিসেবে যখন ডেমরার কাছে পৌঁছলাম তখন ১৬ ডিসেম্বরের সকাল হয়ে গেছে। ডেমরায় পাকিস্তানি ডিফেন্স থেকে তখনো মর্টারের গোলা বর্ষণ চলছে।পাকিস্তানি ডিফেন্সকে পাশ কাটিয়ে দুপুর নাগাদ আমরা এসে হাজির হলাম ঢাকার উপকণ্ঠে, মুগদাপাড়ায়। এরপর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে মতিঝিলের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় আবার থমকে দাঁড়ালাম ডিআইটি ভবনের পুরনো টেলিভিশন স্টেশনের সামনে। তখনো টিভি স্টেশনের ওপর পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে ফেললাম।

বাংলাদেশের ম্যাপ অঙ্কিত একটি পতাকা নিয়ে এক দৌড়ে চলে গেলাম ডিআইটি ভবনের একেবারে মাথায়। দ্রুতই পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে সে জায়গায় লাগিয়ে দিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আমার হৃদয়ে প্রশান্তি নেমে এলো। ওপর থেকে নেমেই দেখি ক্র্যাক প্লাটুনের সহযোদ্ধা সদস্যরা মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে উঁচিয়ে অন্তরের সমস্ত শক্তি উজাড় করে গগনবিদারী সেøাগান তুলছে : ‘জয় বাংলা জয় বাংলা’। গর্বে অন্তরটা ভরে উঠল। ফের ওপরের দিকে একনজর তাকালাম। দেখলাম, আমার হাতে লাগানো বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকা পত পত করে উড়ছে। ঢাকার শহরের বুকে প্রকাশ্যে লাগানো এটাই হচ্ছে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

গাজী গোলাম দস্তগীর তার স্মৃতিচারণায় বলেন, সাংগঠনিক ক্ষমতা, মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও রণচাতুর্যের কারণেই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে ক্র্যাক প্লাটুনের কমান্ডার করার সিদ্ধান্তটি যথার্থ ছিল।  আনন্দমুখর এই পরিবেশে উপস্থিত ছিলেন, ক্র্যাক প্লাটুনের কমান্ডার মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম,গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক এমপি,মহাবিবুল আলম বীর প্রতীক, ও এসপি মাহবুব, মুস্তফা আমিন বাবুল, মাহফুজুর রহমান আমান, মাহবুবুর আলম খান রিজভী, সামসুদ্দীন আহমেদ, ওয়ালী মুহাম্মদ অলি, আঃ রশিদ, এ.কে.এম তাসলিমউদ্দিন, আলী আকবর, মুকবুল ই-ইলাহি চৌধুরী মাশগুল, ডাঃ মাসুদুর রহমান, মনসুর আমান, হাফিজুর রহমান হারুন, জিল্লুর রহিম দুলাল, নুরুল বাবুলসহ শহীদ ও মৃত পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত হন।

উল্লেখ্য, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সহধর্মিণী এবং মুক্তিযুদ্ধে তার বিশেষ প্রেরণাদাত্রী পারভীন চৌধুরী রীনা, তার জ্যেষ্ঠ পুত্র সাজেদুল হোসেন চৌধুরী দিপু, পুত্রবধূ সূবর্ণা চৌধুরী বীনাসহ সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টোয় প্রতিবছর গেরিলা যোদ্ধাদের এই মিলনমেলাটির আয়োজন করা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here