প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ না হলেও এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। সেই লক্ষ্যে সম্প্রতি যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর ছয় শীর্ষ নেতাকে সহযোগিতা করতে সংশ্লিষ্ট জেলার নেতাদের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে চিঠি পাঠিয়েছে বিএনপি। তবে এ চিঠির কারণে শরিক দলের কেউ খুশি হলেও বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বইছে সমালোচনার ঝড়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আড়াই মাসের মাথায় হঠাৎ আসনভিত্তিক এ চিঠি দেওয়ায় বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, দেখা দিয়েছে বিভক্তি ও বিভাজন। বিএনপির ভেতরেও চলছে তর্ক-বিতর্ক। ফলে আরও কয়েকজন নেতাকে সহযোগিতার জন্য চিঠি দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। যদিও বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, তৃণমূলে পাঠানো এ চিঠির বিষয়ে তারা জানেন না। এটি নির্বাচনী আসন চূড়ান্তের কোনো চিঠিও নয়।
নির্বাচনের সঙ্গেও কোনো সর্ম্পক নেই। একই কথা বলছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানরা। তারা বলেছেন,চিঠি দেওয়ার আগে তাদের কাছ থেকে কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। তাদের প্রশ্ন, নির্বাচনী আসন উল্লেখ করে প্রচার-প্রচারণার জন্য এখনই কেন চিঠি দেওয়া হলো? যখন ফ্যাসিবাদীদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, তখন এমন চিঠিতে তৃণমূলে বিভক্তি ছড়িয়ে পড়ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের জোট শরিকদের কোনো কোনো নেতাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে চিঠিতে কী লেখা আছে, তা তিনি জানেন না। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলের নেতারা যাতে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন, সেজন্য বিএনপির জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বলে দেওয়া হয়েছে।
কারও সঙ্গে যাতে কারও মনোমালিন্য না হয়, সেই লক্ষ্যে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। এটি তো নির্বাচনের মনোনয়ন নয়। সুতরাং এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দলের ছয় নেতাকে তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করতে বিএনপির জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বগুড়া-২ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা-১২ আসেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি,পটুয়াখালী-৩ আসনে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, ঝিনাইদহ-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এবং কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদার জন্য দপ্তর থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠির অনুলিপি সংশ্লিষ্ট শীর্ষ নেতাদেরও দিয়েছে বিএনপি।
প্রতিটি চিঠিতে বলা হয়েছে গত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট নেতারা সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ওই সব আসনের থানা-উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির নেতাকর্মীকে জোট নেতাদের জনসংযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহায়তা করতে বলা হয়েছে। এই আদেশ অতীব জরুরি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব চিঠির বাইরে বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমসহ বেশ কয়েকজনকে মৌখিকভাবে তাদের নির্বাচনী আসনে কাজ করতে বলা হয়েছে।
তাদের সহায়তার জন্য সংশ্লিষ্ট আসনের বিএনপি নেতাকর্মীকে এ বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে যুগপৎ অন্য শরিকদের দল ও জোটের নেতাদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে মনোকষ্ট। তাদের চিঠি না দেওয়া বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে তারা বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করেছেন। জানা গেছে, কেন্দ্রের পাঠানো এই চিঠি নিয়ে বিএনপির তৃণমূলে বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তিতর্ক মেতে উঠেছেন দলীয় সর্মথকরা। নির্বাচনের ‘কপাল পোড়ার’ আগাম বার্তা পেয়েছেন বিএনপির অনেকেই। তাই জাতীয় নির্বাচনের আগেই তাদের মনে ক্ষোভের আগুন চলছে।
আর এ ঝড় যুগপৎ শরিকদের ফেলেছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। জোটের কয়েকজন নেতা জানান, চিঠি দেওয়ার পর তারাও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। বিএনপি নেতাদের পাশে পাচ্ছেন, আবার পাচ্ছেন না। ৫ আগস্টের পর নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে ওইসব নেতা বিএনপির নেতাকর্মীর বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে তাদের অনুসারীদের হামলা করা হয়েছে, মামলা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ডকে অবহিত করলে তারা এ চিঠি দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীকে সহায়তা করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবশ্য তারা এ-ও বলছেন, এ চিঠির মাধ্যমে জোটের কয়েক নেতাকে আসনভিত্তিক নির্বাচনে প্রাক-নমিনেশনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। আগাম একটি বার্তাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এবার জোটকে ছাড়তে নারাজ। ফলে তারা পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছিলেন।
চিঠি পাওয়ার বিষয় স্থানীয় একাধিক নেতা বলেন, কেন্দ্রীয় বিএনপি থেকে পাঠানো একটি চিঠি নিয়ে তৃণমূলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, সংশ্লিষ্ট নেতারা ধানের শীষের মনোনয়ন পেতে পারেন। গত ১৬ বছর হামলা-মামলা উপেক্ষা করে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা দলের হাল ধরে রেখেছেন। দলকে শক্তিশালী করেছেন জেলা-উপজেলার শীর্ষ নেতারা।
এখন অন্য কাউকে প্রার্থী হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হলে তারা মানবেন না। মূলত জোট শরিক নেতাদের এলাকায় ভোট ব্যাংক শূন্য। লক্ষীপুর-৪ আসনে বিএনপির হাল ধরেছেন আশরাফ উদ্দিন নিজান। তাকে ছাড়া এ আসনে অন্য কাউকে দিলে বিএনপির নেতাকর্মীরা সমর্থন করবেন না। বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নির্বাচনের জন্য নয়, বরং সাংগঠনিক সহায়তার জন্যই এই চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠির ভুল ব্যাখ্যা করে ওইসব নেতা ও তাদের অনুসারীরা মনোনয়ন প্রাপ্তির প্রচারণা চালাচ্ছেন, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনা বলেন, জেলা বিএনপির সভাপতি এমএ মজিদের বাইরে অন্য কাউকে মনোনয়ন দিলে তৃণমূল মেনে নেব না। আবার কাউকে প্রার্থী হিসেবে চাপিয়ে দিলেও ঝিনাইদহের মানুষ মানবে না, বরং প্রতিহত করবে। সামাজিক মাধ্যমে বিস্ময় প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবং পরে দলটির কট্টর সমালোচক গোলাম মওলা রনি লিখেছেন অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন! মতামত বা মন্তব্য জানতে চেয়েছেন।
বাস্তবতা হলো, বিষয়টি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আর এটা নিয়ে আমার কোনো প্রতিক্রিয়াও নেই! বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যা করেন, তা নিজের ইচ্ছায় স্বাধীনভাবে করেন। তিনি আরও বলেন নুরুল হক নুরু দীর্ঘদিন থেকেই তারেক রহমানের প্রিয়জন এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তি। নুরু গোপনে এবং প্রকাশ্যে বিএনপির জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন। বিএনপি একটি কৃতজ্ঞ দল এবং তারেক রহমানের কৃতজ্ঞতাবোধ সর্বজনবিদিত।
সুতরাং তিনি যদি তার দুঃসময়ের সহযোদ্ধা এবং একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত মানুষকে কোনো কিছু দিতে চান, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়!বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন আমরা ত্রিমুখীভাবে কাজ করছি। বিএনপি প্রথমে ২৭ দফা সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করেছিল। পরবর্তী সময়ে শরিক সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়েছি।
সেখানে আমরা আন্দোলনরত শরিক দল ও জোট নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনের কথা বলেছি। তাই নির্বাচনের জয়লাভ করুক আর না করুক তাদের জাতীয় সরকারের নিয়ে আসার অনেক পথ রয়েছে। তিনি বলেন শরিকরা নির্বাচনে আসনের প্রত্যাশা করছে, এটি পজেটিভ। বিএনপি সহযোগিতা জন্য চিঠি দিয়েছে, কিন্তু ওই চিঠিতে কোথাও বলা হয়নি, এটি নির্বাচনের নমিনেশন পেপার বা আসন দেওয়া হবে।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন এলাকায় জনসংযোগ কাজে সহযোগিতা চেয়ে বিএনপির কাছে চিঠি দিয়েছিলেন শরিক নেতারা। মূলত স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রচার-প্রচারণায় বাধা দিচ্ছিলেন, কোনো ধরনের সহযোগিতাও করছিলেন না। চিঠি দেওয়া পজিটিভ। অন্যদের চিঠি না দিলেও তাদের কোনো ক্ষোভ নেই।
চিঠির বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন চিঠি দেওয়ার পর তো একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, এটাকে নির্বাচনের নমিনেশন হিসেবে বিবেচনা করছে। তবে এলাকার সাধারণ জনগণ ক্লিন ইমেজের মানুষ, চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিমুক্ত তরুণ নেতৃত্বে চায়। বিগত আন্দোলনে বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গুরুতর ভূমিকা রেখেছে গণঅধিকার পরিষদ।