প্রেসনিউজ২৪ডটকমঃ নিজস্ব সংবাদদাতা: ঈদের ছুটি শেষে এখনো চিরচেনা রূপে ফেরেনি রাজধানী ঢাকা। ফাঁকা নগরীতে বাসাবাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন, অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এডিস মশার বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে বেড়েছে ডেঙ্গু ঝুঁকি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অনেক এলাকায় গরুর হাটের ময়লা-আবর্জনা ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় তা পরিণত হয়েছে মশার আবাসস্থলে।
সিটি করপোরেশন ঈদের ছুটিতে মশক নিধন কার্যক্রমে তেমন মনোযোগী ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে নগরীতে মশার উপদ্রব বেড়েছে কয়েকগুণ। ডেঙ্গু আতঙ্কে দিন পার করছেন রাজধানীবাসী। হাসপাতালেও বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর চাপ।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফাঁকা বাসায় জমে থাকা পানি ও নির্মাণকাজ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকায় ভবনে এডিস মশা বংশবৃদ্ধি করেছে। তাই এখনই নগরবাসীর পাশাপাশি সিটি করপোরেশন কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে আষাঢ়ের বৃষ্টি।
বৃষ্টি ও গুমোট আবহাওয়া এডিস মশার প্রজননের উপযুক্ত সময়। এমন অবস্থা চলবে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ে মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৭-২৬ এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত বর্ষা-পূর্ববর্তী জরিপে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২৯টি ওয়ার্ড ও উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১২টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার উচ্চ ঘনত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে।
যেসব স্থানে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ৪২ দশমিক ৩৩ শতাংশ উঁচু ভবন, ২১ দশমিক ৬ শতাংশ পৃথক বাড়ি, ২১ দশমিক ৬ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবন, ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ আধা-কংক্রিট ঘর ও ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ খোলা জায়গা। এডিসের প্রজনন উৎসগুলোর মধ্যে প্লাস্টিকের ড্রামে ১৮ শতাংশ, মেঝেতে জমে থাকা পানিতে ১৫ শতাংশ ও প্লাস্টিকের বালতিতে ১৪ শতাংশ পাওয়া গেছে। এডিস প্রজননে ঢাকা উত্তরের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে—১২, ১৩, ২০, ৩৬, ৩১, ৩২, ১৭ এবং ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড।
আর ঢাকা দক্ষিণের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে—৪, ১৩, ৫২, ৫৪, ১৬, ৩, ৫, ১৫, ১৭ ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ড।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে সারা দেশে অন্তত ৪১ জন মারা গেছেন এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ৩৮৫ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩ হাজার ১৯৪ জন। গতকাল একদিনে সারা দেশের হাসপাতালে ৪২ রোগী ভর্তি হয়েছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, জুরাইন এলাকায় বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে এডিস মশার লার্ভা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, জুরাইনে থাকা খালগুলোর পানিপ্রবাহ বন্ধ থাকায় অল্প বৃষ্টিতেই বাসাবাড়িতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা আর বাড়ে মশার প্রকোপ। স্থানীয় বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান বলেন,খালের পাশে এবং প্রধান সড়কে মশার ওষুধ ছিটাচ্ছেন মশককর্মীরা; কিন্তু অলিগলি এবং বাসাবাড়িতে কাজ করা হচ্ছে না।
একটু বৃষ্টি হলেই পানি আটকে থাকে। মশার যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। দিনের বেলাতেও প্রচুর মশা। মশারি টানিয়ে ঘুমাইতে হয়। মশক নিধনে নিযুক্ত কর্মীরা জানান, দুদিন পরপর মশা নিধনে ওষুধ দিলেও জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের জায়গা না থাকায় কমছে না মশার উপদ্রব।মিরপুরের পীরেরবাগ ও শেওড়াপাড়া এলাকায় মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের যথাযথ উদ্যোগ নেই বলে দাবি এলাকাবাসীর।
ওয়ার্ডের সীমানা ঘেঁষা অপরিচ্ছন্ন খাল এবং মানুষের অসচেতনতায় বাড়ছে সংক্রমণের শঙ্কা। স্থানীয় বাসিন্দা মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে যে ধোঁয়াটা দেওয়া হয়, এতে কোনো কাজ হয় না। একটা মশাও মরে না। গত মৌসুমে বাসিন্দাদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন ডেঙ্গু জ্বরে। সঙ্গে এবারের ঝুঁকির বিষয়টি তো আছেই।
মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা সানজিদা শানজিদা বলেন ঈদের ছুটির মধ্যে করপোরেশনের কর্মীরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময়ে মশার সংখ্যা অনেক বেড়েছে।কীটতত্ত্ববিদ জিএম সাইফুর রহমান বলেন এবারের ঈদে প্রায় এক সপ্তাহ ছুটি ছিল, এটা এডিসের বংশবিস্তারের জন্য যথেষ্ট। ফলে নতুন প্রজনন উৎস বৃদ্ধির আশঙ্কা অনেক বেশি। এসব দেখভালের জন্য মনিটরিং সেল থাকলে ঝুঁকি কম হতো; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা নেই।
ছুটির পর ঘরে ফিরে মশা মারার ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি এডিসের প্রজনন উৎসগুলো ধ্বংস করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওঅফিসগুলোকেও বন্ধের পর খোলার আগে মশক নিধনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।তিনি বলেন সিটি করপোরেশন এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা দীর্ঘ ছুটির পর ক্লাস শুরু হওয়ার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মশা নিরোধক স্প্রে করতে পারেন।
এ বিষয়ে আরও সচেতনতা তৈরি করা খুবই প্রয়োজন। কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন নির্মাণকাজ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকায় নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশা বংশবৃদ্ধি করবে। তাই ওই সাইট ও ভবন-সংলগ্ন স্থানগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য জমে থাকা পানিতে কেরোসিন বা ব্লিচিং পাউডার দেওয়া যেতে পারে।
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন ঈদের আগে নগরবাসীকে নিজ দায়িত্বে বাসাবাড়ি পরিষ্কার করা এবং কোথাও যেন পানি না থাকে, তা দেখে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। এক সপ্তাহের ছুটির মধ্যে শুধু ঈদের দিন তাদের মশক নিধন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ঈদের আগে ও পরে প্রতিটি দিন ফগিং ও লার্ভিসাইডিং কার্যক্রম চালু ছিল।
মাঠপর্যায়ে ৯৭৫ জন কর্মী ও সুপারভাইজার কাজ করছেন। সকাল ও বিকেলে রুটিন মেনে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। প্রয়োজন হলে আরও জোরদার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে গতকাল মৌসুমের প্রথম ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে ডিএসসিসি। ২০৪টি বাসাবাড়ি ও নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করে এবং এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় ৬টি বাসাবাড়ি ও স্থাপনাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খাইরুল আলম বলেন এডিস মশার মৌসুম শুরুর বেশ আগে থেকে ঢাকা উত্তর এলাকায় কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপের ঢাকা উত্তরের যেসব ওয়ার্ড এডিসের প্রজনন বাড়ার ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে, সেখানে বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ঢাকা উত্তরের মশা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বরে উপদ্রব বাড়লে তা নিয়ন্ত্রণে তাৎক্ষণিক যা যা করা দরকার হয়, তা করা হবে। ঈদের ছুটিতে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা।
মুগদা হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় মাণ্ডা থেকে আসা রেহানা বেগমের সঙ্গে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছেলের শরীরে যেন আর মশা না বসতে পারে, সেজন্য সারাক্ষণ নজরে রাখছেন। তিনি বলেন আমার ছেলে ঈদের আগের দিন থেকে অসুস্থ। পরপর দুজন ডাক্তার দেখাইছি, কিন্তু ভালো হয়নি। এজন্য হাসপাতালে ভর্তি করেছি। শনির আখড়া থেকে অসুস্থ মাকে নিয়ে এসেছেন শিপ্রা দাস।
তিনি বলেন আগের বছর আমার ছেলে আক্রান্ত হয়েছিল। এ বছর মাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি।মুগদা হাসপাতালে ঈদের পর থেকে জ্বর, শরীর ব্যথা আর বমি নিয়ে গড়ে রোগী ভর্তি হচ্ছেন ১০ জন করে, যাদের বেশিরভাগই এসেছেন ঢাকার ডেঙ্গু উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে। ডেঙ্গু আক্রান্ত একজন বলেন শরীরে কেঁপে কেঁপে জ্বর আসে।
এখানকার চিকিৎসা ভালো পাওয়ায় এখন ভালো আছি। মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন ডেঙ্গুর ধরন পাল্টানোর রোগীদের শরীরে দেখা দিচ্ছে নানা জটিলতা। ফলে রোগীদের সুস্থ হতে ৭-১০ দিন সময় লাগছে। ঈদের সময় অন্য রোগী কমে গেলেও ডেঙ্গু রোগী কমেনি।